বাগেরহাটে দুই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা ভিক্ষা করছেন : ভিটে-মাটি যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামির দখলে

মোঃ কামরুজ্জামান বাগেরহাট :
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার দুই মুক্তিযোদ্ধা গরজ উদ্দিন সরদার ও হাচেন আলী সরদারের সন্তানেরা এখন ভিক্ষাবৃত্তি ও দিনমজুরি করে জীবীকা নির্বাহ করছে। বারইখালী ইউনিয়নের দক্ষিন সুতালড়ী গ্রামে পৈত্রিক ভিটে বাড়িতে তাদের মাথা গোজার ঠাইটুকুও নেই। বসতবাড়িসহ প্রায় আড়াই শ’ বিঘা জমির সবই অন্যের দখলে।
অভিযোগ রয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই স্থানীয় রাজাকার আলবদররা মুক্তিযোদ্ধা সৈজদ্দিন সরদার ও সেরাজ উদ্দিন সরদারকে জবাই করে হত্যা করে। এর পরে হাচেন ও গরজ উদ্দিনকে মারপিট করে বিভিন্ন মামলায় জড়ায়। পরিবারের সদস্যদের উপরেও চালানো পৈশাচিক নির্যাতন। পুড়িয়ে দেয়া হয় বসত ঘর। গুরুতর আহত অবস্থায় দেশ স্বাধীনের ৭দিন পরে হাচেন আলীকে নিয়ে তার ছেলে মেয়েরা ঘষিয়াখালী গ্রামে হাচেন আলীর শ্বশুর বাড়ি আশ্রয় নেয়। ১৯৭৬ সালে সেখানেই বিনা চিকিৎসায় মারা যান হাচেন আলী। নি:স্ব তার ৪ সন্তান সবুরজান বিবি, জলিল সরদার, সূর্যবান বিবি ও খলিল সরদার ওই গ্রামে ভিক্ষাবৃত্তি ও দিনমজুরী করছে। জন্ম সনদ জমা দিতে না পারায় এখানো ভাতা তালিকায় নাম ওঠেনি হাচেন আলীর।
২০১০ সালে দায়ের হওয়া একটি যুদ্ধাপরাধ মামলার বাদি হাচেন আলীর মেয়ে সূর্যবান বিবি জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হাচেন আলীর সন্তানেরা কালিবাড়ি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে থাকতেন। ’৭৬ সালে পিতার মৃত্যুর ১বছর পর থেকেই হাচেন আলীর মেয়ে সূর্যবান বিবি (৬০) তাদের ভিটেবাড়ির সন্ধানে নামেন। কিন্তু তেমন কোন ফল হয়নি। দফায় দফায় শুধু শালিষ বৈঠক হয়েছে। সর্বশেষ মাঠ জরিপে.৩১শতক জমি রেকর্ড হয় এই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নামে। ১৬ শতক জমি আপোষে ছেড়ে দেন যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি দখলদার সত্তার খান। ২০১৪ সালে .১৬ শতক জমি অলিয়ার খানের দখল থেকে জোর পূর্বক দখলে নেন সূর্যবান বিবি। অলিয়ার খান ওই জমির কোন দলিল দেখাতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামিরাই এই দুই মুক্তিযোদ্ধার ভিটেবাড়ি দখল করে তাদের সমন্তানদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন সূর্যবান বিবি।
হাচেন আলীর চাচা গয়জদ্দিন সরদার স্বাধীনের প্রায় ১০ বছর পরে ঘসিয়াখালী গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে মারা যায়। তার ৮ ছেলে মেয়ের সকলেই এখন ঠিকানাবীহীন। মেয়ে ওরশনারা বেগম (৫৭) ও যমুনা বেগম (৬৫)খুলনার রাম নগর ও রহিম নগরে ভিক্ষা করে। মালতি বেগম (৬২) দিনমজুরী খাটছে রহিম নগরে। ঢাকায় দিনজুরী করে ছেলে লাভলু সরদার (৫৫)। অভাবের তাড়নায় ভারতে কাগজ কুড়িয়ে রুজি জোটাচ্ছে মেয়ে মায়া বেগম (৬০) ও মর্জিনা বিবি (৫৮)।
দুই মুক্তিযোদ্ধার অসহায় সন্তানেরা ও স্থানীয় লোকজন জানান, হাচেন আলী সরদারের ভিটেবাড়ি এখন নাজিম খানের দখলে। ইউনুস হাওলাদারের দখলে গয়জদ্দিন সরদারের ভিটেবাড়ি। তবে তারা কিভাবে এই বাড়িঘর ভোগ দখল করছে তা কারো জানা নেই।
এ সম্পর্কে ওই জমির কথিত দখলকারী যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি ২৭২নং ভাষন্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অলিয়ার রহমান খান বলেন, ‘গয়জদ্দিন ও হাচেন আলী তাদের সকল জমি বিক্রি করে গেছেন। জবরদখলের অভিযোগ মিথ্যা।’ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান লাল বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পরে ওই পরিবার দুটি গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। তাদের জমিজমা কেউ জোরপূর্বক দখল করছে কিনা তা আমার জানা নেই’।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘অছিম উদ্দিন সরদারের ছেলে গয়জদ্দিন সরদার ও ছদের উদ্দিন সরদারের ছেলে হাসেন আলী সরদার ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীনতা বিরোধী তথা প্রভাবশালী ভূমি দস্যুরা ওই দুই মুক্তিযোদ্ধার অনেক জমি বে-আইনীভাবে ভোগ দখল করছে। প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ছাড়া তা উদ্ধার সম্ভব নয়’।
ভাতা তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হাচেন আলীর নাম না ওঠার বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মঞ্জুরুল হাসান বলেন, ‘যথা সময়ে জন্ম সনদ জমা দিতে না পারায় হাচেন আলীর নাম তালিকায় এখানো ওঠেনি। তবে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন’।
