আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বিশেষ আয়োজন
মানবতার সেবায় একজন ‘হাসি আপা’
‘হাসি আপা’ এই এক নামেই পরিচিত তিনি। রাস্তায় বেরুলেই সবাই সালাম দেয় হাসি আপাকে। ছোট-বড় সকলের কাছেই তিনি হাসি আপা, এই নামেই পরিচিতি, এই নামেই সমাদৃত। তবে পুরোনাম নাম কাজী রুহিয়া বেগম হাসি। তার কাছে ধনী গরীব, হিন্দু-মুসলিম বা বৌদ্ধ-খৃষ্টানের কোন ভেদাভেদ নেই। সমভাবেই সব শ্রেণীর মানুষকে ভালবাসেন এই পরোপকারী মহিলা।
১৯৫৪ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারী টুঙ্গিপাড়া উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রামে মাতুলালয় জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম কাজী আব্দুল করীম, মায়ের নাম হালিমা খাতুন।
পিতা পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার সয়না রঘুনাথপুর ইউনিয়নের শিষ্যা গ্রামের সন্তান কাজী আব্দুল করীম পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী এবং শিক্ষক। মা হালিমা খাতুন গৃহিনী। পাশাপাশি জীবনভর লোকচক্ষুর অন্তরালে সমাজ সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছেন।
খুব ছোট বেলায়, তখন ‘হাসি আপা’ চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। পড়াশুনা করতেন চট্টগ্রামের কুসুম কুমারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তখন পিতা কাজী আব্দুল করীম সেখানে একটি কলেজে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। সেই সময়কালে মা-বাবা ও তাদের পাঁচ ভাইবোনের সুখী সমৃদ্ধ পরিবার ছিল। ৩ বোন ও দুই ভাইদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। কিন্তু হঠাৎ করে তাদের পরিবারে যেন ঝড় ওঠে। নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। শিক্ষক পিতা রোগে আক্রন্ত হয়ে মারা যান। শোকাচ্ছন্ন পুরো পরিবারে আর কোন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকায় পাঁচ ভাই-বোনকে নিয়ে মা হালিমা খাতুন চলে আসেন স্বামীর বাসস্থল কাউখালী উপজেলার শিষ্যা গ্রামে। সেখানের একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী ভর্তি হন হাসি আপা।
সংসারের বড় মেয়ে হওয়ায় শিশু বয়সেই তাকে লড়তে হয় নানা বৈরি পরিস্থিতির সাথে। তখনকার পথঘাটের যাতায়াত ব্যবস্থা খুব একটা ভাল ছিলনা। মাইলের পর মাইল পায়ে হেটে স্কুলে পৌছাতে হতো। শিষ্যা মডেল প্রাইমারি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষায় তৎকালীন যশোর বোর্ডে ২য় স্থান অর্জন করেন হাসি আপা। তখনকার দিনে তিনি মাসে ৫ টাকা এবং বছরে বৃত্তির ৬০ টাকা উপার্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে কাউখালী মাইনর স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে অনেকের নজর পড়েছে এই অসহায় পরিবারটির উপর, আর সদ্য বেড়ে ওঠা মেয়েটির উপর। এই কিশোরী বালিকাটিকে নিয়ে লোকজনের নানা কানাকানি শুনে মা হালিমা ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তাকে বিয়ে দিয়ে দেন।
বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর ম্যারিন প্রকৌশল বিভাগে কর্মরত একই গ্রামের কাজী আব্দুল লতিফ এর সাথে তার বিয়ে হয় ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায়। বিয়ের পর প্রথম ৩ বছর তার পড়াশুনা বন্ধ থাকে। চতুর্থ বছরে তার মা পিরোজপুরে অবস্থান করলে তিনি মায়ের কাছে এসে থাকতে শুরু করেন এবং পূনরায় পড়াশুনা করতে শুরু করেন। অষ্টম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা যেদিন শেষ সেদিনই তার কোল জুড়ে আসে প্রথম সন্তান। সে অবস্থায় ১৯৬৯ সালে এসএসসি পাশ করতে সক্ষম হন। এরপর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এর বেশ কিছু দিন বছর পরে তাঁর বড় ছেলের চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণকালে হাটহাজারি কলেজ থেকে তিনি ¯œাতক পাশ করেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী ‘হাসি আপা’ শৈশব থেকেই ছিলেন স্বাধীন চেতা। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করতেন হৃদয়ে। সে লক্ষেই তৎকালীন পিরোজপুর মহাকুমার নেতা মরহুম এনায়েত হোসেন খান এর হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। পকিস্তানে অবস্থানরত চাকুরীজীবী আত্মীয় স্বজনরা বার্তা দিয়েছিলেন নৌকার পক্ষে কাজ করতে। ১৯৭০ এর নির্বাচনে তিনি তাই নৌকার পক্ষে কাজ করতে শুরু করেন। এসময় তিনি পিরোজপুর-বরিশাল অঞ্চলসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সন্নিধ্যে রাজনীতির সুযোগ পান। প্রয়াত রাষ্টপতি জিল্লুর রহমান, তার স্ত্রী আইভি রহমান এর সাথেও ছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। স্থানীয় রাজনীতিতে ন্যায় ও সত্যধর্মী অংশের সাথে তার ছিল এক আত্মীক সখ্যতা। এরই মধ্যে তার কোলজুড়ে আসে দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ তিন সন্তান। কিছুদিন সক্রীয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। নানা প্রতিকূলতার কারণে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের অক্ষমতার কষ্ট থেকে ছেলে মেয়েদের মানুষের মত মানুষ করার জন্য প্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন।
সেখানেও সফল হন হাসি আপা। তার তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় সন্তান কাজী অনিরুদ্ধ এখন একজন সেনা কর্মকর্তা। কর্মরত আছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (কর্নেল) পদবীতে, ছোট ছেলে কাজী অভিজিৎ প্রথমে সিলেট ক্যাডেট কলেজে এইচএসসি এরপর ভারতের গুজরাটের বড়াদা এমএস ইউনিভার্সিটি থেকে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ভারতের পূনা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত আছেন। একমাত্র মেয়ে কাজী অমিতা সোমা ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে পূনা ইউনিভার্সিটি থেকে ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে আমেরিকায় কর্মরত আছেন। প্রত্যেকের রয়েছে সাজানো সংসার।
হাসি আপা পুনরায় ফিরে এসেছেন সাধারণ মানুষের কাছে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কাউখালী উপজেলা থেকে একবার ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে জয়লাভ করেছেন। পরের বার তিনি আর নির্বাচনে অংশ নেন নি। রাজনীতিতে তার বড় কোন পদ পদবী নেই। তিনি তা চানও নি কখনো। এরই মধ্যে শহীদ ওমর ফারুকের নামে একটি কিন্ডার গার্টেনের উদ্যোগ নিয়ে তিনি সফল হয়েছেন।
অবহেলিত নারী সমাজের জন্য গড়ে তুলেছেন “দেশ দশ’’ নামের একটি সংগঠন। নারীদের পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘শ্যামক’ তার হাত দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এছাড়া নানা সামাজিক কর্মকান্ড এবং শিক্ষা বিস্তারেও হাসি আপার অবদান রয়েছে। তিনি স্থানীয় আর্থ সামাজিক মানব উন্নয়ন সংগঠন ও স্কুল কলেজে হঠাৎ উপস্থিত হয়ে মেধাবীদের হাতে বাংলা অভিধানসহ নান মূল্যবান বই উপহার দিয়ে থাকেন।
অবহেলিত নারী সমাজকে প্রাধান্য দিয়ে ১৯৯৬ সালে গড়ে তুলেন “দেশ দশ’ নামের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন মূলক সংগঠনটি। এর লক্ষ ও উদ্দেশ্য ছিল অবহেলিত নারী ও শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তাদান ও আর্থিকভাবে সাবলম্বি করা। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীকে কর্মজীবী করে গড়ে তোলা, সেই সাথে আর্থিক সহয়তা প্রদান করে স্বনির্ভর করার পর তাকে তার পরিবারের সহায়ক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা।
‘দেশ দশ’ থেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের নিয়ে পিরোজপুর সদর উপজেলায় তিনিই প্রথম গড়ে তোলেন শ্যামক নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যেখানে মেয়েদের বস্ত্র বিক্রি করা হতো।
স্কুল থেকে ঝরে পড়া অবহেলিত শিশুদের পাঠদানের লক্ষে গড়ে তোলেন অমিতা শিক্ষালয়। এ কাজে তিনি স্থানীয় কয়েকজন নারীর সহয়তা নিয়েছেন।
ভাষার মাস কিংবা স্বাধীনতার মাসে তিনি নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন কিন্ডার গার্টেন, স্কুল-কলেজে হাজির হয়ে যান। তিনি জাতীয় দিবসগুলোর গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন। এছাড়াও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পুরষ্কার বিতরণ করেন।
বিভিন্ন রোগাক্রান্ত দুঃস্থ ব্যক্তিকে আর্থিক সহযোগিতা করে থাকেন বিভিন্ন সময়ে হাসি আপা। চলতি বছর নবীন লেখিকা আফরোজা মুন্নি ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তিনি তাকে কোলকাতা নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
আফরোজা মুন্নি বলেন, হাসি আপা আমার সমস্ত চিকিৎসার ব্যয় বহনের সাথে সাথে কোলকাতা পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। তার পরিচিতজনদের কাছ থেকেও টাকা সংগ্রহ করে আমার চিকিৎসার সহযোগিতা করেছেন। মনে হয় ওনার উছিলায় আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। এছাড়া অনেক বেকার লোকের চাকুরীর ব্যবস্থা করেছেন রুহিয়া বেগম হসি।
এ ব্যাপারে কথা বলতে গেলে কাজী রুহিয়া বেগম হাসি এ প্রতিবেদককে বলেন, “ছোট একটা জীবনে অনেক চড়াই উৎড়াই দেখেছি, নিজেও লড়েছি বৈরি পরিস্থিতির সাথে। আজ আর কোন পিছুটান নেই। সন্তানরা স্ব-স্ব স্থানে প্রতিষ্ঠিত। তাই আবার ফিরে এসেছি সাধারণ মানুষের কাছে। কি পেয়েছি সে হিসেব করছিনা। কি দিতে পারলাম সে হিসেবে নিয়েই বাকি দিনগুলো কাটাতে চাই।”
হাসি আপার ব্যাপারে মহিলা পরিষদের সভাপতি মনিকা মন্ডল বলেন, ‘হাসির তুলনা সে নিজেই। লড়াকু এক নারী সত্য বলতে যেমন পরোয়া করেনা তেমনি মানুষের কল্যাণে এগিয়ে যেতেও পিছ পা হয়না। সমাজের জন্য এমন মেয়ে কজনই বা আছে।’
মেয়ের বিষয়ে মা হালিমা খাতুন বলেন, আমার প্রথম সন্তান এই মেয়েটি। সংসারে তখন অভাব অনটন ছিল। গ্রামে পরিবেশে মেয়েদের মানুষ করা সহজ ছিল না। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বিয়ে দিলেও হাসি আমার ছেলে সন্তানের ভূমিকাই পালন করে গেছে। আজ আমার সবকটি সন্তান সু-প্রতিষ্ঠিত। এর পিছনে বড় মেয়ের অবদান কম কিছু নয়।
হাসি আপার ব্যাপারে তার ছোট ছেলে ড. অভিজিৎ বলেন, মাকে ভালোবেসে সমাজের লোকজন অনেক সম্মাননা দিয়েছে। আর আমাদের কাছে আমার মা একটি অহংকার।
হাসি আপার ছোট বোন শিরিন আক্তার জেলা আওয়ামী লীগ এর সহ-সভাপতি এবং সাবেক প্রধান শিক্ষিকা। তিনি বলেন আমার তো কখনো মনে হয়নি সে আমার বোন। তার সাহস দৃঢ়তা দেখে মনে হয়েছে সে আমার বড় ভাই। এখনো পারিবারিক যে কোন সিদ্ধান্তে আমরা বড় বোনকে প্রাধান্য দেই।
এ ব্যপারে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সালমা জাহান বলেন, যতদুর জেনেছি হাসি আপা জীবন সংগ্রামে জয়ী একজন নারী। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তিনি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।