প্রধান সূচি

ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন ও বাস্তবতা

সংবাদ-১: গণমাধ্যমে প্রকাশি খবর বলছে, ঈদকে সামনে রেখে ঢাকাসহ সারাদেশে ভারতীয় শাড়ি, থ্রি-পিস আর কসমেটিকস সামগ্রীর চাহিদা বেড়েছে। এজন্য নারী ক্রেতাদের ভিড় করছেন ভারতীয় শাড়ি-থ্রিপিসের দোকানে। রাজধানীর নিউ মার্কেট, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও ধানমন্ডির ছোট-বড় বিভিন্ন পোশাকের এমন চিত্র। ধানমন্ডির রাপা প্লাজার নীল আঁচল শাড়িজ নামের দোকানে ভারতের তেলেঙ্গানার তৈরি এক একটি গাদোয়াল শাড়ি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শুধু শাড়ি নয়, ভারতীয় থি-পিস, ঘারারা, সারারা, গাউন, আলেয়া কাট ও লেহেঙ্গা মানভেদে ৩ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় বিভিন্ন দেকোনো বিক্রি হচ্ছে।

সংবাদ-২: রাজধানীর বাইরেও দৃশ্যটা প্রায় একই রকম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার ভারতীয় পোশাক বিক্রি বেড়েছে। দাম কিছুটা বেশি হলেও ক্রেতাদের সামর্থ্যের মধ্যেই আছে। নায়রা, গারারা, সারারা, কাতান, ভারতীয় থ্রি-পিস সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। শাড়ির মধ্যে বেশি বিক্রি হচ্ছে ফোর প্লে, মণিপুরী ও কাশ্মীরি কাতান বেশি চলছে। এছাড়া ইন্ডিয়ান লেহেঙ্গা বিক্রি হচ্ছে বেশ।

সংবাদ-৩: রোদের তেজ বাধা দিতে পারেনি ভারতের কলকাতার ঈদবাজারে। সেখানে ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশিরাই বেশি। ধর্মতলা থেকে গড়িয়াহাট, শিয়ালদহ থেকে রাজাবাজার বা বেলগাছিয়া-পার্ক সার্কাস থেকে এন্টালি-খিদিরপুর—সব জায়গার বিপণিবিতানের একই চিত্র। কলকাতার বাংলাদেশি হোটেলপাড়া বলে পরিচিত নিউমার্কেট এলাকায় কমবেশি প্রায় তিন হাজার বিপণিবিতান রয়েছে। এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান ক্রেতা বাংলাদেশি পর্যটক।

ক্যাম্পেইন ও বাস্তবতা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সরব ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন। বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলও এই ক্যাম্পেইনের সাথে যুক্ত হয়েছে। এক নেতা ৩/৪ বছর ভারতীয় শাল ব্যবহারের পর তা রাস্তায় ফেলি দিয়ে ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইনে সরব হয়েছেন। আর ফেসবুকে প্রবেশ করলে মনে হয়- ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইনের কারণে ভারতীয় কোনো পণ্যই দেশে বিক্রি হচ্ছে না। ঈদের কেনাকাটাতেও ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলছে- কেউ আর ভারতীয় পোশাক কিনছেন না। কিন্তু গণমাধ্যমের খবর দেখে সেটি মনে হলো না। বরাবরের মতো এবারও ভারতীয় পোশাকের চাহিদা বেশি, বিক্রিও বেশি। আবার কলকাতার নিউ মার্কেটেও বাংলাদেশি ক্রেতাদের ভিড়ে ঠাসা।

ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্য: বিএনপি বারবার বলছে, ভারতের সর্মথন থাকায় বর্তমান সরকার টিকে রয়েছে। ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তারা এদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু বিশ্ব ভূরাজনৈতিক কৌশলে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারকে যারা সমর্থন দিচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছে ভারত, চীন এবং রাশিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশ। অথচ বিএনপি ইন্ডিয়া আউট বললেও, চীন আউট বা রাশিয়া আউট ক্যাম্পেইন করছে না।

যেসব পণ্য বর্জনের ডাক: ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইনে চার ধরনের ভারতীয় পণ্য বর্জন করার কথা বলা হয়েছে। এক. ফাস্ট মুভিং কনজুমার্স গুডস, যেমন- তেল, নুন, চিনি, পেঁয়াজ ইত্যাদি। দুই. ভারতীয় সান ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি। চার. এয়ারটেল সিম। চার. ভারতীয় ওটিটি চ্যানেল যেমন- হইচই, আড্ডাটাইমস, ক্লিক। এসব পণ্য বর্জন করলে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়বে?

পরিসংখ্যান যা বলছে: ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ভারত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৯৭ ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর একটা বড় অংশ দখল করে আছে তুলা, সুতাসহ পোশাক খাতের কাঁচামাল। জাতিসংঘের বাণিজ্য বিষয়ক ডেটাবেসের তথ্য অনুযায়ী, ওই অর্থবছরে বাংলাদেশ এই খাতে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার আমদানি করেছে প্রতিবেশি দেশ থেকে। দ্বিতীয় অবস্থানে তেল ও অন্যান্য খনিজ জ্বালানি। এছাড়া, ভারত থেকে বাংলাদেশে যেসব খাদ্য-পণ্য আমদানি হয় তার মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, সূর্যমুখী ও সয়াবিন তেলসহ ভোজ্য-তেল, চিনি, মধু, কোমল পানীয়, চিপস, বিস্কুট, চকলেট ও ক্যান্ডি জাতীয় খাবার।

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য-অর্থনীতি: বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর দেশ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঘাটতি খুবই স্বাভাবিক বিষয়। একই চিত্র ভারতের ক্ষেত্রেও। ভারতের সাথে আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে বৈষম্য অনেক বেশি। কিন্তু বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য হলো, বিএনপি আমলে শুধু আমদানিই হয়েছে, রপ্তানি হয়নি বললেই চলে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সময়ে আমদানির পাশাপাশি রপ্তানিও বেড়েছে অনেক।

বিএনপির ১৯৯৫ সালে ভারত যতো টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে তার মাত্র ১২ ভাগের একভাগ রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ২০০০ সালে এটা ৮ ভাগে কমে এসেছে। আওয়ামী লীগের সময়ে রপ্তানি বেড়েছে, আমদানি কমেছে। একইভাবে খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় আমলে ২০০৫ সালে আমদানি হয়েছে ১.৭২ বিলিয়ন ডলারের, আর রপ্তানি হয়েছে ১০৪ মিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ আমদানির ১৭ ভাগের একভাগ মাত্র রপ্তানি। আওয়ামী লীগের সময়ে বাণিজ্য বৈষম্য যেখানে কমিয়ে আনা হয়েছিল, সেটা দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ ২০২২-এর চিত্রেও দেখা যায়, ভারতে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর বিপরীতে প্রায় ৬ গুণ আমদানি হয়েছে, যা বিএনপি আমলে ছিল ১৭ গুণ। অর্থাৎ খালেদা জিয়ার সময়ের থেকে বাণিজ্য ঘাটতি তিনভাগের একভাগে কমিয়ে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বয়কটের ডাক দেওয়া চার পণ্যের আর্থিক মূল্য বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যের মাত্র ১ শতাংশের কাছাকাছি। এই ১ শতাংশ পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে যারা ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করছে বলে দাবি করছেন তারা মানুষকে বোকা বানাতে চেষ্টা করছে। এখন আর ৯১ সাল নয়, একটি মিথ্যা বললেন আর মানুষ তাবিশ্বাস করবে, সে অবস্থা এখন আর নেই। প্রতিটি তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ আছে প্রতিটি মানুষের হাতে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।






উত্তর দিন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.