প্রধান সূচি

আমাদের পক্ষে কী আদৌ ভারত বর্জন সম্ভব ?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা ছবি দেখে এই লেখাটি লেখার ইচ্ছে হয়। ছবিতে এক নারী একটি একটি প্লাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। সেটায় লেখা “৩৫ লাখ বাংলাদেশি মুসলমানের চিকিৎসা সুবিধা বন্ধ করে দেয়ার অনুরোধ করছি”। ভদ্রমহিলা ভারতীয়। সম্ভবত সাম্প্রতিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডাক দেয়া ভারত বয়কট কর্মসূচির একটা পাল্টা জবাব দিলেন তিনি। নিজের দেশ সম্পর্কে এত আজেবাজে কথা শুনলে যে কেউ এরকম প্রতিক্রিয়া দিতে পারেন। নিশ্চয়ই এরকম কথা পাল্টা কথা চলতেই থাকবে। মাস দুই আগে বাংলাদেশে একটা ক্রিকেট ম্যাচে ভারতীয় দলের বিরোধিতা করা নিয়ে একই রকম বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল।

বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতার এই ধারা নতুন নয়। ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে ভাগ করে সাধারণ মানুষকে শোষণ করার এই বৃটিশ কৌশল বহু পুরোনো। এই সুড়সুড়িতে বৃটিশরা মানুষ হওয়ার আগে ভারতবাসীকে হিন্দু অথবা মুসলমান বানিয়েছিল। তাদের কলোনিতে ফেলে আমাদের মগজে একে অপরকে অপছন্দ করার এমন বিষ ঢুকিয়েছিল যা ৭৫ বছরেও মাথা থেকে বের হলো না। কবি নজরুল লিখলেন “বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনও বসে- বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে।”

আজ বৃটিশ নেই। কিন্তু আমরা তাদের শেখানো সেই কলোনিয়াল বিরোধিতা থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি। কারণ আর কিছু নয়, আমাদের মাথা থেকে ধর্মীয় বিরোধিতার ভূত যাচ্ছে না, বা যেতে দেয়া হচ্ছে না কিম্বা রেখে দেয়া হচ্ছে। খুবেই অদ্ভুদ ব্যাপার, এত উন্নয়ন ঘটে গেলো! এখন মুহূর্তেই মানুষের চিন্তা চলে যায় বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। কিন্তু আমাদের কুপমণ্ডুকতা গেলো না। এখনও বহু বাংলাদেশি ভাবছে ভারত হিন্দু ধর্মের মানুষের দেশ, আর কিছু ভারতীয় ভাবছে বাংলাদেশে মুসলমানের দেশ।

এত কথা বললাম, কারণ আমরা জানি আমাদের এই উপমহাদেশে দুই ধর্মের মানুষের বিরোধিতাজনিত ট্যাবু খুব শক্তিশালী। এই ট্যাবু আসলে ক্রয়যোগ্য পণ্য। যখন যার দরকার সে তখন এটা ব্যাবহার করে। শুধু আমরা সাধারণ মানুষেরা এটা বুঝতে পারি না। এই যেমন এখন চলছে ভারত বয়কট নামের প্রচার। যেটা ওই ভারত বিরোধিতা ট্যাবুরই অংশ। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কারা এই প্রচার কে শুরু করেছিল তা প্রকাশ্য হয়নি। তবে সব শেষ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রকাশ্য তার গায়ের চাদর খুলে রাস্তায় ফেলে তার ভারত বিরোধিতা কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছেন।

আমারা এখন দেখবো ধর্মীয় বিরোধ কেন্দ্রিক ভারত বিরোধিতা ট্যাবু কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রুহুল কবির রিজভীর কথা পরে বলছি। প্রথমে দেখি, কেন হঠাৎ করেই ভারত বর্জন প্রসঙ্গ আসলো? আমার মনে হয় উদ্যোগের শুরুটা ছিল বাণিজ্যিক। পাঠক আপনারারাই খোঁজ নিয়ে দেখুন, যেসব পণ্য বর্জন করতে বলা হচ্ছে এর প্রত্যেকটা পণ্যের বিপরীতে বাংলাদেশি পণ্য আাছে না হয় অন্যদেশ থেকে আমদানি করার ইস্যু আছে। সেক্ষেত্রে এই ক্যাম্পেইন কারো জন্যে খুবই কার্যকরি। কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্নটাতো রয়েই গেলো?

ভারতীয় পণ্যের বিপরীতে আমার দেশের পণ্য থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশি পণ্য বলে যে কেউ তার পণ্য ক্রেতার সামনে এগিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সেই দেশের পণ্য বর্জনের আহবান তো ন্যূনতম নৈতিক নয়। আমরা বাজার অর্থনীতি মেনে নিয়েছি। সুতারাং প্রতিযোগিতায় টিকতে গেলে আমাকে পণ্যের মান ও দাম নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হবে। শুধু ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহবান হয়তো প্রাথমিক ফল দেবে। কিন্তু তা কখনই টেকসই হবে না। কারণ কম দামে ভাল পণ্য কেনার বিষয়টি মানুষের পকেটের সঙ্গে জড়িত।
আসছি রিজভী সাহেবের প্রসঙ্গে। তিনি কেন গায়ের চাদর ফেলে ভারত বর্জন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন? কারণ সদ্য শেষ হওয়া জাতীয় নির্বাচনে ভারত বাধা দেয়নি। তাই তিনি অভিমান করেছেন। তারা বলতে চান, ভারতের আশীর্বাদে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন করতে পেরেছে। আসলেই কী তাই? ভারতের একাধিক কূটনীতিক গণমাধ্যমে বলেছেন, বাংলাদেশে কে ক্ষমতায় আসবে, কীভাবে নির্বাচন হবে সেটা একেবারেই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সেখানে তারা হস্তক্ষেপ করতে চায় না।

যেকোন দেশের ক্ষেত্রেই তো তাই হওয়া উচিত। কোন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কোন পর্যন্ত মূল্যায়নের আওতায় আনা যাবে এর একটা আন্তর্জাতিক প্রথা আছে। স্বাভাবিকভাবে দেখা হয় দেশটি সংবিধান কতটুকু মানুষ বান্ধব? সেই সংবিধান অনুযায়ী দেশটি পরিচালিত হচ্ছে কী না। ভারতও তাই দেখেছে। কিন্তু রিজভী সাহেবের আবদার, সোস্যাল মিডিয়ায় গুজবের জোয়ার তারা তৈরি করেছে। সেই জোয়োরে কেন ভারত গা ভাসালো না। কেন ভারত তাদের বন্ধকী গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ালো না।

সবাই আসলে সহজেই সফল হতে চায়। তাই এই দুটে উদাহরণ সামনে আনলাম। এই আসলে আমাদের ভারত বিরোধিতার সূত্র। যখন যার দরকার তখন তিনি ভারত বিরোধিতা করেন। দরকার মিটলে ক্লান্তি কাটাতে ভারতে যান। আসার সময় ব্যাগ ভর্তি শপিং করেন, হেলথ চেকআপ করান। এটা আসলে না করিয়ে উপায় নেই। আমাদের বিনোদনে ভারত লাগে, চিকিৎসায় ভারত লাগে, শিক্ষায় ভারত লাগে। এমনকী খাবারের চাল, গম এবং পেঁয়াজ আমাদানিতে ঘাটতি হলে বাজারে হাহাকার লাগে। আমার পোশাক শিল্পের সূতা আসে ভারত থেকে। যারা আজ ভারত বর্জন করতে বলছেন তারা কখনও পারবেন এই সব পণ্য বর্জন করে দেশ চালাতে? রিজভী সাহেবের দলও পেরেছিলো?

আমি মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলছিলাম। ভারত আসলে প্রতিবেশিদের তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে নিজের যোগ্যতায়। ওই অর্থে ভারত আসলে প্রভাব বিস্তার করেনি। ভারত নিজের যোগ্যতা বাড়িয়েছে, আর আমরা জীবন বাঁচাতে তার প্রভাবে পড়েছি। আমরা সেই প্রভাবে না পড়লে ভারতের কিছু যেত আসতো না। দেশ দখল করার সেই দিন তো বদলে গেছে বহু আগে। এখন বাজার দখল হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতি হলে সেটাও করতে হয় না। দক্ষতার কারণে দখল হয়ে যায় আসলে।

ভারত কিন্তু কখনই আমাদের যোগ্যতা অর্জনে বাধা দেয়নি। কিন্তু আমরা এই সহজ সত্যটি বুঝতে পারি না। তাই ভারত বয়কট কর্মীদের কাছে আমার জিজ্ঞাস্য, আমরা আর কতদিন আটকে থাকবো, কবি নজরুলের বিবি তালাকের ফতোয়ায়? মনে রাখবেন আমাদের সেই জাতীয় কবিও ভারতীয় বংশোদ্ভূত। আমরা কী কখনও তাঁকেও বয়কট করতে পারবো?

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।






উত্তর দিন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.