প্রধান সূচি

জামায়াতের রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার

ইসলাম ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে জামায়াত বাংলাদেশের জনগণের সাথে প্রতারণার জাল বিস্তার করেছে। একটি দেশের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ভোট প্রদান ও অন্যান্য ক্ষেত্রে জনগণকেই সকল ক্ষমতার উৎস গণ্য করা হয়। একটা সময় ছিল যখন বিশ্বের অনেক দেশে ‘বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস’ হয়ে উঠেছে, এমন ঘটনা বিস্তর।

বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বন্দুকের নলের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদ দখলের বিরুদ্ধে তখন বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের দেয়ালে দেয়ালে চিকা লেখা হতো ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। এর বিপরীতে তখন সত্তোরের শতকে জামায়াতপন্থীরাও দেয়ালে চিকা লিখতে শুরু করল, বলা শুরু করল ‘আল্লাহই সকল ক্ষমতার উৎস’- এটা শুধু মাত্র পাকিস্তানীপন্থীদেরকে সহায়তা করার জন্য।

পাকিস্তানী সামরিক দখলদাররা যখন বাংলাদেশের জনগণের দিকে রাইফেল তাক করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নিতে থাকল তখন রাজনৈতিক চিন্তায় ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হতে থাকল। কিন্তু জামায়াত ইসলামের নামে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে তাঁদের সামনে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করল ‘আল্লাহই সকল ক্ষমতার উৎস’ প্রচারের মাধ্যমে।

যারা ভাবল সামরিক বুটপরে রাইফেল ঘাড়ে চাপিয়ে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করা যায়, এ স্লোগান ছিল তাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের জনগণকে সচেতন করতে এই স্লোগান। নাগরিকরা যাতে বুঝতে পারে কোনো অবস্থাতেই হঠাৎ করে রাতের আঁধারে যে কেউ জনগণের দিকে স্টেনগান তাক করে রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার রাখে না। এখানেই জামায়াত মুনা-ফিকীর আশ্রয় নিল। তারা জেনে বুঝে আল্লাহর নামে স্লোগান সামনে এনে জনগণের একাংশকে বিভ্রান্ত করল।

কোনো মুসলিম আল্লাহর নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব নিয়ে কখনো প্রশ্ন তুলতে চেষ্টা করেনি। অন্য কোনো ধর্মের মানুষ সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়নি,করেও না। কিন্তু জামায়াত জনগণের সাথে প্রতারণা করল, ভয় দেখালো, সাবধান! সব ক্ষমতা আল্লাহর, মানুষের কোনো ক্ষমতা নেই; যারা মানুষের ক্ষমতায় বিশ্বাস করে তারা কাফির-মুশরিক-মুরতাদ। জনগণ এতে ভিমরি খেয়েছে, ভয় পেয়েছে। এখনো জনগোষ্ঠীর এক অংশ জামায়াতের এই প্রতারণার জালে আটকে আছে। অথচ ‘জনগণের ক্ষমতা’ বিষয়ক স্লোগান ছিল নিতান্তই দেশের রাষ্ট্র পরিচালনাকে কেন্দ্র করে।

জামায়াত নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য জনগণকে বুঝাতে চেয়েছে আল্লাহ কতো বড় ক্ষমতাবান, মূলত তারা আল্লাহকে হেয় করছে খাটো করার অপপ্রয়াস দেখাচ্ছে; তাদের স্পর্ধার সীমা কতদূর! এই ধর্ম ব্যবসায়ীদেরকে আল্লাহ অবশ্যই হাশরের দিবসে শাস্তির আওতায় আনবেন।

এদেশের আন্দোলনমুখী জনগণ যখন রাজনীতির নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে স্লোগান দেয়া শুরু করল, ‘আমার নেতা, তোমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব ’তখন জামায়াত নবীজী সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই স্লোগানের প্রতিপক্ষ বানালো। জামায়াত স্লোগান তুলল, ‘আমার নেতা, তোমার নেতা, বিশ্বনবী মোস্তফা’। নিশ্চয় এসব ঘটনা বোদ্ধা ব্লগার ও পাঠকদের মন থেকে উধাও হয়ে যায়নি।

জামায়াত জানতো, শেখ মুজিব বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক নেতা। তাই এ ধরনের স্লোগান উঠতেই পারে। কিন্তু তারা ধর্মপরায়ণ মানুষের মনে ধর্মের সুড়সুড়ি দিল, নষ্ট খেলা শুরু করল। জামায়াত বলল যে দাঁড়িপাল্লা হলো হাশরের ময়দানের মিযান। এই মিযানেই নেকী-বদীর ওজন হবে। যদি মুসলমান হও, হযরত মুহম্মদকে স্বীকার করো, তবে আমাদের এই দাঁড়িপাল্লায় ভোট দাও। মুনাফিকীর পথ বেছে নিয়েও জামায়াত সারা বাংলার মানুষের মন জয় করতে পারেনি।

নবীজী হযরত মুহম্মদের নেতৃত্বে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে তা পবিত্র ধর্মীয় যুদ্ধ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত চরম প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তৎকালিন বদর বাহিনীর নামে আল বদর বাহিনী গঠন করল ইসলাম রক্ষার নামে।

বাংলাদেশের জনগণ নিপীড়ন বৈষম্যের বিরুদ্ধে যখন মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তখন তারা এই প্রতিরোধ যুদ্ধের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের নামে আল বদর বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে খুন,ধর্ষণ,অগ্নিসংযোগসহ এমন কোন অপকর্ম নেই যা তারা বাদ রেখেছে। ইসলামের বদর বাহিনীকে তারা এভাবে কলঙ্কের অপচেষ্টা করেছে, যা একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে মেনে নেওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

জামায়াত জেনে বুঝে স্লোগান দিয়েছে, ‘তোমার আমার সংবিধান; আল কোরআন, আল কোরআন’। দুনিয়ার কোনো মুসলিমই পবিত্র কোরআনকে অস্বীকার করে না। কিন্তু জামায়াত ভুল বুঝাতে চেষ্টা করল যে তোমরা যে সংবিধান মেনে চলেছ আসলে কোরআনকেই অস্বীকার করছো, কোরআনই হচ্ছে একমাত্র সংবিধান। তারা পবিত্র মহাগ্র্ন্থকে দেশের সংবিধানের প্রতিপক্ষ করে তুলল।

সাধারণত যে কোন রাষ্ট্রের নিজ নিজ ভূখন্ড থাকে, ইতিহাস-ঐতিহ্য থাকে, জাতিসত্তা থাকে, আইন-কানুন থাকে। এসব কিছুকে ধারণ করে একটি সংবিধান থাকে। জামায়াত তা জানে এবং বোঝে। যদি নাই জানবে, তাহলে এই সংবিধানে‘ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ও ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ সংযোজন-বিয়োজন নিয়ে তাদের এতো মাথা ব্যথা কেন? তারা জানে এই সংবিধানের আলোকেই দেশ পরিচালিত হয়। তবুও এই অপকর্মটি তারা করে যেনতেন উপায়ে বেশির ভাগ অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষকে যাতে বিভান্ত এবং বিচলিত করে তোলা যায়। এতে প্রতারণার জাল বিছানোর কাজ সহজ হয়।

তারা সত্যিই যদি পবিত্র কোরআনকে সংবিধান মানে, সেই পবিত্র গ্রন্থে বিসমিল্লাহ তো আছেই। তবে যে সংবিধান তারা মানে না, সেই সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজিত থাকল কি থাকল না তাতে তাদের কী আসে যায়? তাদের রাজনীতি মূলত কপটতার, তারা কপটচারি।

জামায়াতের স্লোগান ‘সৎ লোকের শাসন চাই, দাঁড়িপাল্লায় ভোট চাই’। তাদের দাবি, দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিলেই সৎপ্রার্থীকে নির্বাচিত করা হবে। জানি না জামায়াত কবে, কখন, কীভাবে, কোন আমলে, সততার নমুনা হাজির করেছে জাতির সামনে? নারী ধর্ষণ, নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্মান্তরিত করণে বাধ্য করা, আন্দোলনের নামে বৃক্ষ নিধন, শত শত বিদ্যালয় পুড়িয়ে দেয়া, শিশুদের নুতন বছরের নুতন বই পোড়ানো, পবিত্র কোরআনে আগুন দেয়ার পরিকল্পিত কর্মসূচি নিশ্চয় নজির বিহীন সততা?

জামায়াত পরিচালিত ব্যাংক, হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ, কোচিং সেন্টারসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো কি সৎ পরিচালন পদ্ধতি মেনে চলে? জামায়াত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে তাদের জন্য যা কিছু বা গিয়ে নিয়েছে তা কি আইন সিদ্ধ? পাবনায় শ্রীমতি সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক বাড়ি অবৈধ দখলে নেওয়া কি সৎ লোকের কারবার?
জামায়াত ধর্মের মোড়কে যত অপরাধের জন্ম দিয়েছে, একাত্তরে আল বদর জন্ম দিয়ে জামায়াত যে অপরাধ করেছে, মুক্তিকামী নিরীহ নারীদের ধর্ষণ করেছে, দগ্ধ করেছে। সেই সকল অপরাধ, দগ্ধ মৃতদেহের দায় জামায়াতকে নিতে হবে।

জামায়াত ইসলামী নারী নেতৃত্বকে হারাম বলে। অথচ তারা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকে পছন্দ করে। এক মুখে দুই কথা এটা কিসের লক্ষণ? বর্তমান বাংলাদেশের উন্নয়ন তাদের পছন্দ হওয়ার কথা না কারণ তারা উপরে বাংলাদেশের কথা বললেও অন্তরে ধারণ করে পাকিস্তান।

এখন বাংলার জনগণ সিদ্ধান্ত নিবে তারা কি ধর্ম ব্যবসায়ীদের সাথে সুর মিলিয়ে কথা বলবে? নাকি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনার পাশে থাকবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।






উত্তর দিন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.