প্রধান সূচি

বুয়েট কি বাংলাদেশের বাইরে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ?

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সে ঘটনা তখন দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। বেদনায় আর্ত হয়েছিল গোটা জাতি। তখনকার আবেগের স্রোতে বুয়েটে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ছাত্র রাজনীতি। সে ঘটনার বিচার চলছে এখনও। নিম্ন আদালত বুয়েটের ২০ শিক্ষার্থীর মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। কিন্তু বুয়েটে আর ছাত্র রাজনীতি ফেরেনি। বাংলাদেশে এখন প্রবল রাজনীতিবিমুখ একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। আর সেই প্রজন্মের নেতৃত্ব দিচ্ছে বুয়েট। এটা দুর্ভাগ্যজনক।

তবে বুয়েট শিক্ষার্থীদের সমস্যাটা কোথায়, বোঝা মুশকিল। তারা কি ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে নাকি ছাত্রলীগের বিপক্ষে? আরও নির্দিষ্ট করে বললে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে। বলা হয়, যেখানে ছাত্র রাজনীতি নাই, সেখানে জঙ্গিবাদের চর্চা হয়। বুয়েট কি এখন জঙ্গিবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে? টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়ে গ্রেফতার হওয়া শিবিরের নেতাকর্মীদের ব্যাপারে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা নিশ্চুপ ছিল। তারা সবাই এখন বুয়েটে নিরাপদে, নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করছে।

নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীর নির্বিঘ্নে তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে। এখানে কারও কোনো আপত্তি নেই। সব আপত্তি ছাত্রলীগ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তির ব্যাপারেই কেন? বুয়েটে ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন করা যাবে না, ১৬ ডিসেম্বর উৎসব করা যাবে না, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ শহীদদের স্মরণ করা যাবে না কেন। বুয়েট কি বাংলাদেশের বাইরে, বুয়েট কি বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ?

এবার যে আবার বুয়েটকে অস্থিতিশীল করে তোলা হলো, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করা হলো; কারণটা কী? ছাত্রলীগ তো সেখানে রাজনীতি করতে যায়নি। বুয়েট তো সেখানে কমিটি দেয়নি। কারও ওপর হামলা করেনি। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বুয়েট ক্যাম্পাসে যাওয়াতেই সবাই এমন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল কেন? ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই পাওয়াটা তো অপরাধ নয়, গর্বের। ছাত্র রাজনীতি না থাকার পরও বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছে, এটাতে তো তাদের গর্বিত হওয়ার কথা। উল্টো তারা সেই ছাত্রের বহিষ্কার দাবি করছে। তার অপরাধটা কী?

বুয়েটে যারা ভর্তি হয়, তারা সবাই মেধাবী এবং তারা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক। নিজেদের ভালোমন্দ বোঝার মতো মেধা তাদের আছে। কে রাজনীতি করবে, কে করবে না; কে ছাত্রদল করবে, কে ছাত্র ইউনিয়ন করবে, কে ছাত্রলীগ করবে; সেটা তার নিজেদের সিদ্ধান্ত এবং এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকারও বটে। অনেক ছাত্র একসাথে মিলে একটা বেআইনি, অসাংবিধানিক দাবি করলেই সেটা মেনে নিতে হবে? বুয়েটের নিজস্ব আইন বা দেশের প্রচলিত আইন তো তাদেরও মানতে হবে। নাকি বুয়েট শিবির আর হিযবুত তাহরীরের নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র হয়েই থাকবে?

ছাত্র রাজনীতি থাকলে পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটবে। এখন যে বুয়েটে আন্দোলন হচ্ছে, তাতে কি একাডেমিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে না। ধরে নিচ্ছি ছাত্র রাজনীতি থাকলে পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়। তাহলে দেশের অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি আছে কেন? শুধু বুয়েটের শিক্ষার্থীরাই পড়াশোনা করবে, আর কারও পড়াশোনা করতে হবে না? হয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছাত্র রাজনীতি থাকবে, নইলে কোথাও থাকবে না। বুয়েট তো বাংলাদেশের বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। তাহলে তাদের জন্য আলাদা আইন থাকবে কেন?’

এখন আওয়ামী লীগের লেজুড় হয়ে গেছে বটে, তবে ছাত্রলীগের জন্ম কিন্তু আওয়ামী লীগেরও আগে। আর ছাত্রলীগের রয়েছে গৌরবের দীর্ঘ ঐতিহ্য। কিন্তু গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগ দানবে পরিণত হয়েছে। বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার কথা তো শুরুতেই বলেছি। বিশ্বজিতকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনাও আমরা ভুলে যাইনি। ছাত্রলীগের নেতারা গত দশকজুড়ে সারাদেশে যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, তার খবর কিন্তু সাধারণ মানুষ জানে।

ছাত্রলীগের মতো ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের নামে এখন গুগলে সার্চ দিলে যা আসে সব নেতিবাচক সংবাদ। হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি হেন কোনো অপরাধ নেই তারা করেনি। ছাত্রলীগ এখন আর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন নয়, বোঝা হয়ে গেছে। তবে আমি ছাত্রলীগকে পুরো দোষ দেই না। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কি কেউ নেই দেশে? দেশের বিভিন্ন স্থানে মূল দলের নেতারাই ছাত্রলীগকে তাদের অপকর্মের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে। আর দোষ হয় ছাত্রলীগের একার। কারা ছাত্রলীগকে দানব বানালো, সেটাও দেখা দরকার।

বুয়েটের যে ছাত্ররা সহপাঠী আবরারকে পিটিয়ে মেরেছিল, তারা সবাই কিন্তু এলাকায় নম্র, ভদ্র হিসেবে পরিচিত। সেই, মেধাবী ছাত্রগুলো কীভাবে বুয়েটে এসে এমন খুনি হয়ে গেলো, বুয়েট কর্তৃপক্ষ কি একবারও ভেবে দেখেছেন? মানলাম ছাত্রলীগাররা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। কিন্তু তাহলে প্রভোস্ট, প্রক্টর, ভিসিরা কী করেন? তারা কেন আটকান না ছাত্রলীগকে? আটকান না, কারণ সেই শিক্ষকরাও দলীয় রাজনীতির বিষে নীল। ছাত্র আর শিক্ষকরা যেন মাসতুতো ভাই।

সমস্যা হলো, ছাত্রলীগের মাস্তানি, চাঁদাবাজি, দখলবাজিকে আমরা ছাত্র রাজনীতির সমস্যা ভেবে বসে আছি। তবে মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা কখনোই সমাধান নয়। ছাত্র রাজনীতি বন্ধের চেষ্টা আসলে বিরাজনীতিকরণেরই চেষ্টা। ছাত্ররা রাজনীতি না করলে, ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য তৈরি না হলে কারা দেশের নেতৃত্ব দেবে? অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী, কালোবাজারি আর দৃর্বৃত্তরা? কেউ কেউ মনে হয় সেটাই চাইছেন।

ছাত্র রাজনীতি করলেই কেউ রসাতলে যাবে, এমন ভাবার কারণ নেই। এখনও যারা বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা ছাত্র রাজনীতি করেই উঠে এসেছেন। যারা ছাত্র জীবনে রাজনীতি করেন, তারা পরে অন্য পেশায়ও নেতৃত্বের পর্যায়ে থাকেন। তাই ছাত্ররাজনীতিকে দোষ না দিয়ে, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে, তার চিকিৎসা দিতে হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতে সব সংগঠন তৎপরতা চালাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের সংগঠন যাতে সাধারণ ছাত্রদের ওপর নির্যাতন চালাতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার চাইলেই সেটা সম্ভব।

সাধারণত ক্ষমতাসীনরা ছাত্র আন্দোলনকে ভয় পায়। তারা কোনো না কোনাভাবে ছাত্ররাজনীতিকে দমিয়ে রাখতে চায়। সরকার যদি ছাত্ররাজনীতি বন্ধের চেষ্টা করতো, সবার উচিত হতো তার প্রতিবাদ করা। এখন হয়েছে উল্টো, প্রধানমন্ত্রী ছাত্ররাজনীতির পক্ষে বলছেন আর যাদের ছাত্ররাজনীতির পক্ষে থাকার কথা সেই সুশীল সমাজ এর বিপক্ষে বলছেন। অদ্ভূত!

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুবাদে ছাত্রলীগ বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু সরকার ছাত্রলীগকে ছাড় দিচ্ছে, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আবরার হত্যার ঘটনায় ২০ জনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। চাঁদাবাজির অভিযোগে, ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করা হয়েছিল। যেখানেই কোনো অপকর্মের খবর আসে, তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বহিষ্কারও করা হয়। এখন ছাত্রলীগ একটা শুদ্ধি প্রক্রিয়ায় আছে। আওয়ামী লীগের টানা ক্ষমতায় থাকার শুরুর দিকে অপকর্মের ঢেউ, নানা ব্যবস্থায় এখন অনেকটাই থিতিয়ে এসেছে।

ছাত্ররাজনীতি নয়, অপরাজনীতি বন্ধ হোক চিরতরে। আর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে আসুক শিক্ষা এবং ছাত্র রাজনীতির সুষ্ঠু পরিবেশ। আবরার হত্যার পর আবেগের প্রবল ঢেউয়ে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সময় এসেছে, বুয়েটে আবার ছাত্র রাজনীতির অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার। কারণ বুয়েটের শিক্ষার্থীদের তো পরে অন্তত প্রকৌশলীদের নেতৃত্ব দিতে হবে। ছাত্র রাজনীতি না থাকলে তারা নেতৃত্বটা শিখবে কোত্থেকে?

বুয়েটে সব সংগঠনের রাজনীতি করার অধিকার থাকুক। পারলে সবাই মিলে এক জোট হয়ে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিক। ইউকসুর নির্বাচনের দাবি সামনে আসুক। সেই নির্বাচনে ছাত্রলীগ গো হারা হারুক। কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু ছাত্রলীগকে ঠেকাতে গিয়ে আমরা যেন ছাত্র রাজনীতিকেই ঠেকিয়ে না দেই। রাজনৈতিক চেতনাবিহীন মেধা নিজের উন্নতি করতে পারবে, দেশের কোনো কাজে আসবে না। ছাত্র রাজনীতির শূন্যতা যেন জঙ্গিবাদ পূরণ করে না ফেলে, এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থীদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।






উত্তর দিন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.