প্রধান সূচি

আত্মহত্যার কারণ নির্ণয় ও প্রতিরোধ

স্বপ্ন হারিয়ে যাওয়ার নাম আত্মহত্যা। একটি আত্মহত্যার ঘটনা কেবল একজন ব্যক্তির হারিয়ে যাওয়া নয়, তার চারপাশের প্রিয়জনের জন্যও অসহনীয় বেদনার। অনেক স্বপ্নের মৃত্যু, একজনের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেকের জীবনের গতির আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে। বিশ্বজুড়ে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ব্যক্তিদের মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ হলে আত্মহত্যা। তবে যেকোনো বয়সের নারী বা পুরুষ আত্মহত্যা ঘটনা ঘটাতে পারেন।
১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধে ২০০৩ সাল থেকে প্রতি বছরের ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে বছরে প্রায় ৬ জন আত্মহত্যা করে থাকেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৮ সালের জাতীয় জরিপ অনুযায়ী ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষের প্রায় ৫ শতাংশ একবারের জন্য হলেও আত্মহত্যা করার চিন্তা করেছে, আর ১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ একবারের জন্য হলেও পরিকল্পনা বা চেষ্টা করেছে। যাঁদের বিষণœতা রোগ রয়েছে, অন্যদের চেয়ে তাঁরা ২০ গুণ বেশি আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম। প্রতি বছর দেশে কমপক্ষে ১৩ হাজার থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে ৮ লাখেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। সংস্থাটির মতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। এছাড়াও এর প্রায় ১৫ থেকে ২০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়।
আত্মহত্যার সঙ্গে লিঙ্গের সম্পর্ক বহুকাল ধরে জড়িয়ে রয়েছে। বিশ্বজুড়ে যদি আত্মহত্যার তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, মহিলারা আত্মহত্যার পথ বেশি বেছে নেয়। কিন্তু আত্মহত্যার কারণে মৃত্যু বেশি হয় পুরুষদের ক্ষেত্রে। কারণ পুরুষরা আত্মহত্যার যে পথ বেছে নেয়, সেগুলো অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং এতে মৃত্যুর সম্ভাবনাও অনেক বেশি। আমাদের দেশে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার করার সংখ্যাটা বেশি।
১৮-৩০ বছর বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনার পিছনেও কিশোর-কিশোরীদের মতোই প্রেমের সম্পর্ক দায়ী হয়। প্রেমের সম্পর্ক, সম্পর্কে বিচ্ছেদ-এই ধরনের ঘটনাগুলো আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে তুলছে। ১৮-৩০ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধির পিছনে মূলত: বিবাহ সংক্রান্ত সমস্যা দায়ী। ঝোঁকের মধ্যে নিজের ক্ষতি করে ফেলার প্রবণতা এই বয়সের মানুষদের মধ্যে বেশি।
কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি হওয়ার কারণ হল সম্পর্কের টানাপোড়ন। দেখা যায়, এই বয়সের ছেলেমেয়েরা মানসিকভাবে তুলনায় বেশি জড়িয়ে পড়ে প্রেমের সম্পর্কে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সম্পকর্কে কেন্দ্র করে সামান্য কোনও ঘটনাকে কেন্দ্র করেও তারা বড় কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে দেয়। প্রেমের সম্পর্ক ছাড়াও পড়াশোনা সম্পর্কিত বিষয় নিয়েও এই বয়সের ছেলেমেয়েরা মানসিক চাপে থাকে। পরীক্ষায় পাস না করা, আশানুরূপ ফল না-করার কারণেও কিশোর-কিশোরীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
যাদের মধে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে, তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যু আর আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন, কথায় কথায় আড্ডায় মরে যাওয়ার কথা বলেন। সম্প্রতি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন বা নিকটজনের আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে, যা তিনি মেনে নিতে পারছে না। সারা রাত জেগে থাকছে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে, হঠাৎ রেগে যাচ্ছে। আত্মহত্যা বা মৃত্যু বিষয়ক কবিতা ও গান লিখতে, শুনতে বা পড়তে ভালবাসে। নিজে নিজের ক্ষতি করে। প্রায়ই তারা নিজের হাত-পা কাটে, বেশি বেশি ঘুমের ওষুধ খায়। মনমরা হয়ে থাকা, সব কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা, নিজেকে দোষী ভাবা যা থেকে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। মাদকাসক্তি বা ইন্টারনেটে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি। নিজেকে গুটিয়ে রাখা, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়া। পড়ালেখা, খেলাধুলা, শখের বিষয় থেকে নিজে দূরে থাকা। এ ধরনের ইঙ্গিত কারও মধ্যে থাকলে তাকে মন:সামাজিক সহায়তা দিতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায়, কেউ যদি মৃত্যুর কথা বলে, তখন সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। যারা মৃত্যুর কথা বলে, তারা আত্মহত্যা করে না। এমন ধারণাটা ভুল। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, যারা মৃত্যুর কথা বলে তাদের মধ্যেই আত্মহত্যার ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই প্রতিটি মৃত্যুর ইচ্ছাকে আত্মহত্যার ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিতে হবে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধ করার জন্য শিশু-কিশোরদের সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। আত্মহত্যা কেবল কিশোর বা তরুণরা করে না, যে কোনো বয়সের নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করতে পারেন। তাই বয়স্ক বা বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি আত্মহত্যা করবে না এমনটা ভাবা চলবে না। আত্মহত্যার উপকরণ, যেমন ঘুমের ওষুধ ও কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমানো, প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করা। বিষন্নতা, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়াসহ সব মানসিক রোগের দ্রæত শনাক্ত করা ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের সময় গণমাধ্যম যাতে, অনুমোদিত নির্দেশিকা মেনে সংবাদ পরিবেশন করে সেটা নিশ্চিত করা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সতর্কতার সঙ্গে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে ছবি পোস্ট ও মন্তব্য করা, এখানেও কোনো আত্মহত্যার ঘটনাকে খুব মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা করা যাবে না, আবার কারও মৃত্যুর ইচ্ছাকে বিদ্রæপ করা যাবে না।
আত্মহত্যা এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। তাই এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি একে অন্যের আবেগ-উচ্ছ¡াস, সুখ-দু:খে মনোযোগ বাড়ানোর প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অনুভূতিগুলো বলার ক্ষেত্র না পাওয়ায় উদ্বেগ, দু:খ ও হতাশা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার নির্মম পথ বেছে নেয় মানুষ। পারিবারিক নির্যাতন, কলহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, পরীক্ষা ও প্রেমে ব্যর্থতা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রাত্যহিক জীবনের অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয় এবং মাদক ইত্যাদি কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।
আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যেতে হবে। যাঁরা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই আগে থেকে বেশ কিছু ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। আশপাশের কাছের মানুষেরা এই ইঙ্গিতগুলো খেয়াল করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে অনেক আত্মহত্যাই প্রতিরোধ করা যায়। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সবাইকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। আশপাশের কারও মধ্যে আত্মহত্যা করার ইঙ্গিত পেলে তাকে দ্রæত সাহায্য করা, তাঁর পাশে থেকে আত্মহত্যা না করার জন্য নিরুৎসাহিত করা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট






উত্তর দিন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.