প্রধান সূচি

ফিরে দেখা ৫ আগষ্ট-২০২৪ : পিরোজপুরের রাজপথ ছিল ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দখলে

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আজকের এই দিনে পিরোজপুরের রাজপথ ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দখলে। আগের দিন ৪ আগস্ট সকালে শহরের মহিলা কলেজ সড়কে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সাথে ছাত্রলীগ-যুবলীগের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা। এতে করে ছাত্র-জনতার মানসিক শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, পাশাপাশি ৪ আগস্ট যখন তারা জানতে পারে লংমার্স টু ঢাকা ৬ আগস্টের পরিবর্তে একদিন এগিয়ে ৫ আগস্টে নিয়ে আসা হয়েছে এটা শুনে ছাত্রজনতা আরও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
তবে দুপুরে সেনাপ্রধান ভাষণ দিবেন, এটা জানার পর এদিন দুপুর পর্যন্ত ছাত্রজনতা কোন মিছিল সমাবেশ না করলেও শহরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ছিল তাদের অবস্থান।
এরমধ্যে দুপুর দুইটার দিকে যখন শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে, তখন বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে ওঠে ছাত্র জনতা। মুহূর্তেই ছাত্রজনতাসহ সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পিরোজপুর শহর পরিণত হয় এক মিছিল ও আনন্দ-উল্লাসের নগরীতে। তখন মিছিলে স্লোগান ওঠে, ‘এইমাত্র খবর এলো শেখ হাসিনা পালিয়ে গেল’ এবং ‘পালাইছেরে পালাইছেরে (পালিয়েছে) খুনি হাসিনা পালাইছে। এছাড়া ঈদের আনন্দের মত সাধারণ মানুষ পরস্পরের সহিত কোলাকুলি করতে থাকে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের কান্না শুরু করে এবং শুরু হয় মিষ্টি বিতরণ। বিকেলের মধ্যে পিরোজপুর শহরের সকল মিষ্টির দোকান খালি হয়ে যায়।
বিকাল ৪টার দিকে শহরের কেন্দ্রস্থল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ মোড়ে ‘স্বাধীনতা স্টেজ’ তৈরি করা হয়। সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত চলে বিজয় আনন্দ।এ স্টেজে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন দলের নেতারা বক্তৃতা দিতে থাকেন এবং জাসাসসহ স্থানীয় শিল্পীরা দেশাত্মবোধকসহ বিভিন্ন গান পরিবেশন করেন।
বিকেল ৫ টা থেকে শুরু হয় স্বৈরাচার-ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িতে জনতার হামলা। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের নাজিরপুরের বাসভবন, ভান্ডারিয়ায় সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন মহারাজের বাসভবন, পিরোজপুর পৌরসভার মেয়র হাবিবুর রহমান মালেকের বাসভবন ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাদের বাড়িতে উত্তেজিত জনতা ভাংচুর চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। পিরোজপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই মূলত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আর বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলের নেতারা সব সময় ব্যাকআপ টিম হিসেবে কাজ করেছে।
এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজ, আফতাব উদ্দিন কলেজ, সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। তবে আন্দোলনে এদের মধ্যে সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ এবং সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ২২ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। এই ব্যাচের আবিদ জামান সাবিত, তানভীর আহমেদ, রিয়াদ তালুকদার, রেদওয়ান আহমেদ, কাজী রেদোয়ান এরা আন্দোলনের মাঠে সবসময় সরব ছিল।
এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের বাংলা বিভাগের (অনার্স, ১৭/১৮ সেশন) এর শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আমীন সাগর বলেন, ৪ আগস্ট আমাদের প্রতিরোধ ও আক্রমণের মুখে ছাত্রলীগ পালিয়ে যায়। এরপর থেকেই মাঠ আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে ওই দিন রাতে পুলিশের ধরপাকড় থেকে রক্ষা পেতে আমরা কেউ বাসায় ঘুমাইনি। এরমধ্যে আমরা জানতে লংমার্চ টু ঢাকা ৬ তারিখের পরিবর্তে একদিন এগিয়ে ৫ আগস্টে নিয়ে আসা হয়েছে এবং এদিন দুপুরে সেনাপ্রধান ভাষণ দিবেন। তখন ৪ আগস্ট রাতে আমরা সিদ্ধান্ত নেই ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত আমরা কোন মিছিল সমাবেশ করব না, কিন্তু শহরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নিব।
এরপরে দুপুর ২টার দিকে জানতে পারি শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়েছে। আমরা চূড়ান্তভাবে ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছি। এর পরেই শুরু হয় আমাদের বিজয় মিছিল।
আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সহযোগিতা প্রসঙ্গে সাগর বলেন, দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে রাজনৈতিক নেতারা সামনে না আসলেও তারা আমাদের জন্য বিভিন্ন পরামর্শ, ফিনান্সিয়াল সাপোর্টসহ ব্যাকআপ টিম হিসেবে কাজ করেছে।
তাদের মধ্যে অন্যতম জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ রিয়াজউদ্দিন রানাসহ বিএনপি, যুবদল এবং ছাত্রদলের নেতারা।
অন্যদিকে জামায়াতের জেলা সেক্রেটারি জহিরুল হক, সহকারী সেক্রেটারি আব্দুর রাজ্জাক এবং জেলা ছাত্র শিবিরের সভাপতি, সেক্রেটারিসহ আরও অনেকে। হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা দুপুর দুইটার দিকে প্রথমে জড়ো হন পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে (যেটা বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী চত্বর নামে পরিচিত)। এরপর তারা সেখান থেকে মিছিল নিয়ে শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে অবস্থান নেন।
আন্দোলন প্রসঙ্গে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমডি বদিউজ্জামান শেখ রুবেল বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে যেন দলীয় ট্যাগ লাগাতে না পারে এজন্য কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা দলের নেতৃস্থানীয়রা সামনে না থাকলেও আমাদের দলের সকল কর্মীরা এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে। বিজয় লাভের পরে পিরোজপুরের ফ্যাসিস্ট নেতাদের বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন দিলেও কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী হিন্দুদের মন্দির পাহাড়াসহ লুটপাট থেকে শহরকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছি।
এদিকে জেলা জামায়াত এবং শিবিরের নেতাকর্মীরা হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবরে দুপুর দুইটার দিকে প্রথমেই নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থিত আল্লামা সাঈদী ফাউন্ডেশনে প্রয়াত মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর কবর জিয়ারত করে মিছিল নিয়ে শহরের দিকে রওনা হন।
জেলা বিএনপি যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ রিয়াজউদ্দিন রানা বলেন, দুপুর ১২ টায় নতুন বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রায় হাজারখানেক লোকের মিছিল নিয়ে পুরাতন বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগোতে থাকি কিন্তু পথিমধ্যে পুরাতন পেট্রোল পাম্পের সামনে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পের সদস্যরা আমাদেরকে বাধা দেন। আমি আমার পরিচয় দিয়ে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হই যে আমাদের মিছিল হবে শান্তিপ্রিয়। তখন তারা আমাদের মিছিলকে সামনে যেতে দেয়।
এরপরে আমরা পুরাতন বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে অবস্থান নেই। ঘন্টাখানেক সেখানে থাকার পরে শহরের বড় মসজিদ মোড়ে অস্থায়ী ‘স্বাধীনতা স্টেজ’ তৈরি করি। সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত আন্দোলনে শরিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা বক্তব্য দিতে থাকেন।
তিনি বলেন, সন্ধ্যার একটু পরে জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ফোন পেয়ে তার সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে পিরোজপুর সদর থানাকে যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেন। আমি সাথে সাথে আমাদের দলের নেতাকর্মীদের সদর থানার সামনে পাহারায় বসাই। অবশেষে এভাবেই অবসান হয় দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরাচারের নিপীড়ন। পিরোজপুরের মানুষ পায় মুক্তির আনন্দ এবং নতুন স্বাধীনতার স্বাদ।

Please follow and like us:





উত্তর দিন

Wordpress Social Share Plugin powered by Ultimatelysocial