প্রধান সূচি

কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই

ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে রমজান আসে রহমত আর বরকতের অবারিত ধারা নিয়ে। এ মাসের ফজিলত অনেক। ধর্মীয় বিবেচনায় রমজান মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান মাস। তবে বাংলাদেশের বাজারে গেলে বোঝা যায় রমজান আসলেই সবচেয়ে মূল্যবান মাস। সবকিছুর দামই বাড়ে রমজানে। আর রমজানে বরকত হয় শুধু ব্যবসায়ীদের। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে আগে থেকেই বাজার চড়া ছিল। রমজান আসায় বাজারে যেন আগুন লেগেছে। ব্যবসায়ীদের জন্য বরকতের মাস রমজান নির্দিষ্ট আয়ের মানুষদের জন্য দারুণ কষ্ট বয়ে এনেছে। এমনিতে নিয়মিত আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতেই যেখানে হিমশিম দশা, সেখানে রমজান এলে চাহিদা বাড়ে, সঙ্গে বাড়ে দাম। তখন আর হিমশিম খাওয়ারও উপায় থাকে না। তখন আসলে রমজানে উপোস করার দশা হয় সাধারণ মানুষের।

বিশ্বের সব দেশেই ধর্মীয় উৎসবে মূল্য ছাড় দেওয়া হয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রমজান এলেই বিশাল মূল্যছাড় আসে। তারা সারা বছর লাভ করলেও রমজানে সেটা করে না। একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে রমজান এলে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসায়ীরা। তারা সারা বছরের লাভ একমাসে করে ফেলতে চায়। আমার হিসেবে কোনও জিনিসের চাহিদা বাড়লে সরবরাহ ঠিক থাকলে তো দাম কমার কথা। কারণ বেশি বিক্রি দাম কম হলেও লাভ বেশি হবে। সরবরাহে ঘাটতি থাকলে দাম বাড়তে পারে। সরবরাহে ঘাটতি আছে, এমন কথা শোনা যায়নি। বাজারে সবকিছুর সরবরাহ অঢেল, দামও লাগামছাড়া। এমন অন্যায্য বাজার বিশ্বের কোথাও নেই।

টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ দেশকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অর্থনীতির সব সূচকেই বাংলাদেশ বিস্ময়কর অগ্রগতি করেছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে সেই অর্থনীতিই এখন আওয়ামী লীগ সরকারের গলার ফাঁস হয়ে গেছে। বিশেষ করে বাজার পরিস্থিতি সব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এটা আওয়ামী লীগেরও অজানা নয়।

গত নির্বাচনের আগে ঘোষিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকেই এক নম্বর অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। নতুন সরকারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তরুণ ব্যবসায়ী আহসানুল ইসলাম টিটুকে। দায়িত্ব নিয়েই তিনি প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন। সবার সঙ্গে কথা বলছেন। বাজারে বাজারে ঘুরছেন। সেদিন দেখলাম বৃষ্টির মধ্যেই তিনি বাজার পরিদর্শন করছেন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, তার চেষ্টায় কোনও কাজ হয়নি এখনও। বাজারের পাগলা ঘোড়ার লাগাম সরকারের হাতে নেই। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। আমদানি করা পণ্যের দাম না হয়, ডলারের দাম বা যুদ্ধের প্রভাবে বাড়তে পারে। কিন্তু দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম রমজান এলেই লাফিয়ে বাড়বে কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। এই উত্তরটা খুঁজে পেলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। কৃষকের উৎপাদন খরচ আর ভোক্তার কেনা দামে আকাশ-পাতাল ফারাক। রমজানে বাড়তি দামটা যদি কৃষকের পকেটে যেত, তাও না হয় সান্ত্বনা মিলতো। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীরা খেয়ে নেয় কৃষকের লাভ, কেটে নেয় সাধারণ মানুষের পকেট। দিনের পর দিন এই মধ্যস্বত্বভোগী আর সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। সরকারের এত গোয়েন্দা সংস্থা, তারা কেন এই মধ্যস্বত্বভোগীদের খুঁজে বের করতে পারে না। এত প্রভাবশালী সরকার। বিরোধী দলকে তছনছ করে দিতে পারে, কিন্তু সিন্ডিকেট ভাঙতে পারে না কেন।

কৃষি বিপণন অধিদফতর গত সপ্তাহে ২৯টি পণ্যের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো দাম নির্ধারণ করেই খালাস। সাধারণ মানুষ যাতে যৌক্তিক দামে পণ্য কিনতে পারে, তার কোনও ব্যবস্থা করেনি কৃষি বিপণন অধিদফতর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারের কোনও সংস্থা। কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক সাংবাদিকদের বলেছেন, আমরা দাম বেঁধে দিইনি, যৌক্তিক দাম কত হওয়া উচিত, তা নির্ধারণ করে দিয়েছি। সে অনুযায়ী সংস্থাগুলো অভিযান চালাবে, ব্যবস্থা নেবে। মাঠ থেকে আসা তথ্য বিশ্লেষণ করেই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। মাঠ থেকে আসা তথ্য বিশ্লেষণ করে যে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, তারচেয়ে বেশি দাম যারা নিচ্ছেন, তারা অযৌক্তিক কাজ করছেন। যারা অযৌক্তিক কাজ করছেন, তাদের ধরার জন্য নিশ্চয়ই সরকারের বিভিন্ন সংস্থা আছে। ধরা হচ্ছে না কেন?

কৃষি বিপণন অধিদফতর যে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করেছে, সেই দামে বাজারে কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। সবকিছুর দামই চড়া। কৃষি বিপণন অধিদফতরের উদ্যোগটা ভালো ছিল। কিন্তু প্রয়োগ না থাকায় পুরো বিষয়টি হাস্যকর হয়ে গেছে। বাজারের ওপর যে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই, তা আরও দৃশ্যমান। ২৯ পণ্যের যৌক্তিক দামকে এখন সবাই বলছেন, ‘কাজীর গরু, যা কেতাবে আছে, কিন্তু গোয়ালে নেই’।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।






উত্তর দিন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.