বাংলাদেশ সরকারের মানবিক বিবেচনা
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী তমব্রু এলাকার সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি), সরকারি কর্মকর্তা ও সেনা বাহিনী সদস্য সহ মোট ৩৩০ জন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। পরে বাংলাদেশ বার্ডার গার্ডের কাছে নিরাপত্তা চাওয়ার বিষয়টি দেশ-বিদেশে এক ধরনের আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকতে না পেরে এই সদস্যরা জীবন রক্ষার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে।
মিয়ানমার থেকে বিজেপি, সরকারি কর্মকর্তা ও সেনা বাহিনী সদস্যদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের আসল উদ্দেশ্য এবং তাদের প্রবেশ আমাদের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার জন্য কোনও ধরনের ঝুঁকি কিনা তা ভালোভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন।
যেহেতু রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়ার বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার এবং মিয়ানমার সরকারের মধ্যে এক ধরনের বিরোধ চলমান, অতএব সেই বিরোধের আলোকে এই সকল অনুপ্রবেশকারীদের বাংলাদেশে অভ্যন্তরে প্রবেশের বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে সংশ্লিষ্ট সবাই মনে করে।
সীমান্তবর্তী তমব্রু এলাকায় মিয়ানমার বিজেপি সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের আকস্মিক অনুপ্রবেশের বিষয়টি আঞ্চলিক এবং বাংলাদেশের রাজনীতির জটিল পরিণতি ঘটাতে পারে কিনা এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে গভীরভাবে ভাবতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই সকল অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের চলামান সংঘাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে যেখানে আরাকান সেনাবাহিনী এবং সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে উত্তেজনার তীব্রতা রয়েছে। ফলে, এই সদস্যরা বাংলাদেশ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার জন্য কোনোরকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কিনা তা ভালোভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের উচিত মানবিক জরুরি অবস্থার জটিলতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি সমন্বিত, ও সহানুভূতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এখানে উল্লেখ্য যে, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার তার মানবিক দায়িত্ব পালন করেছে। শুধু আশ্রয় নয়, বর্তমানে তাদের পরিচালনা করার কঠিন কাজটি যত্ন সহকারে করছে। বাংলাদেশে অভ্যন্তরে মিয়ানমার বিজিপি সদস্য এবং সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতি যথেষ্ট আশঙ্কার প্রশ্ন তৈরি করে। কারণ এই বাহিনীর সদস্যরাই ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা সংকট তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিল। ফলে, এই ব্যক্তিরা সেই সংকটের স্পষ্ট এবং সরাসরি অনুস্মারক হিসাবে কাজ করেছে। সেই সময় মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এবং বিজিবির যৌথ প্রচেষ্টার ফলে ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গা হত্যা ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল।
২০১৭ সালের ২৪ ও ২৫ আগস্টের নৃশংস ঘটনায় এই সদস্যরা সরাসরি জড়িত ছিল কিনা, অথবা যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের সম্পর্কে কোনও তথ্য রয়েছে কিনা সেটিও খুঁজে বের করতে পারলে ভালো হতো। তাদের পরিচয় যাচাই-বাছাই করাও দরকার। কারণ তাদের মধ্যে এমন কোনও ব্যক্তি থাকতে পারে যারা মিয়ানমার সরকারের গোপন কর্মী হতে পারে। আর যদি থেকে থাকে তাহলে তারা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য সম্ভাব্য হুমকির কারণ হতে পারে। ফলে, অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা খুব জরুরি।
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমার বিজিপি, সেনা সদস্য এবং সরকারি কর্মকর্তাদের অনুপ্রবেশের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এই জটিল সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজতে তারা মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আন্তঃসীমান্ত উদ্বেগের সমাধানে সক্রিয়ভাবে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। তারা ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে পারস্পরিক সুবিধাজনক সমাধান খুঁজে বের করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় অব্যাহত দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে এই জটিল সমস্যার সমাধান করতে চায়। এর লক্ষ্য হলো দক্ষতা ও কূটনীতির মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা, এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের স্বার্থ ও কল্যাণ রক্ষা করার পাশাপাশি ফলপ্রসূ সংলাপ নিশ্চিত করা।
তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যসহ বাকিদের জাহাজে তোলার প্রক্রিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু করেছে। ১৬৫ জনকে নিয়ে একটি জাহাজ জেটি ছেড়ে গেছে। পরে একইদিন বাকি ১৬৫ জনকেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
তবে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অন্য ধরনের কৌশল প্রয়োগের কথাও ভেবেছেন। তারা মনে করেন যে, বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রাথমিকভাবে এই পালিয়ে আসা সামরিক কর্মীদের পরিচয় নিশ্চিত হতে হবে এবং পূর্ববর্তী চরম নিষ্ঠুরতায় তাদের কথিত অংশগ্রহণের তদন্ত করতে হবে। তাদের প্রত্যাবাসন বা শাস্তির বিষয়ের সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে কেবলমাত্র রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের জড়িত থাকা বা না থাকার একটি বিশ্লেষণের ওপর।
তাছাড়া, এই বিষয়ে তারা বিশ্ব সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে তারা মত প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে একটি ন্যায়সঙ্গত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজে) বা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) সহায়তা চাওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের সাথে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষা করার পাশাপাশি ন্যায্যতা ও দায়িত্ব বজায় রাখার মনোভাব প্রদর্শন করতে পারে।
যে পক্ষ যে কথাই বলুক না কেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমার বিজিপি সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের অনুপ্রবেশের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার একটি কৌশলী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা একদিকে যেমন মিয়ানমার সরকারের সাথে অনুপ্রবেশকারীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে, ঠিক তেমনিভাবে এই বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে উপস্থাপন করেছে।
মিয়ানমার সরকারের সাথে আলোচনার অংশ হিসেবে ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদের মিয়ানমার পাঠিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ফলে, অনুপ্রবেশ ইস্যুটির আপাতত পরিসমাপ্তি হচ্ছে যা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির। এই সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকার মানবিক বিবেচনা, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং ন্যায়বিচারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে যা প্রশংসার দাবি রাখে।
আঞ্চলিক রাজনীতির জটিলতার মধ্য দিয়ে সর্বোত্তম পথ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রতি তাদের নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায় বর্তমান পরিস্থিতিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং এই বিষয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য উল্লেখযোগ্য ও দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি নিয়ে আসবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় যার জন্য সাহসিকতা, সহানুভূতি এবং দৃঢ় সংকল্পের প্রয়োজন। আমারা বিশ্বাস করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে সকল সমস্যার একটি বাস্তবধর্মী সমাধান হবে।
লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।