প্রধান সূচি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে টিআইবির প্রতিবেদন উদ্দেশ্য প্রণোদিত, পক্ষপাতমূলক ও অনুমান নির্ভর

গত ১৭ জানুয়ারি ২০২৪ রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া ট্র্যাকিং’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে ”ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ”দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন” একপক্ষীয় ও পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে। সংস্থাটি বলেছে, এবারের নির্বাচন অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক দেখাতে নিজ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়া হলেও ২৪১টি আসনে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি। নির্বাচনে শেষের এক ঘণ্টায় ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ ভোটসহ মোট ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়া বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন একতরফা নির্বাচনের ‘অ্যাজেন্ডা’ বাস্তবায়নের অন্যতম অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রশাসন অনুরূপভাবে একই ‘অ্যাজেন্ডা’র সহায়ক ভূমিকায় ব্যবহৃত হয়েছে।

আমি মনে করি, টিআইবির প্রতিবেদন উদ্দেশ্য প্রণোদিত, বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতমূলক ও অনুমান নির্ভর। এধরনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে তাঁরা তাদের পশ্চিমা প্রভুদের খুশি করে বাংলাদেশের একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলার অপচেষ্টা মাত্র। গত ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচন যে অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল তা নিম্নে যুক্তিরসহকারে তুলে ধরছি।

১. মনোনয়ন যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছ থেকে ৩০০টি সংসদীয় আসনের বিপরীতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) মোট ২ হাজার ৭১৬টি মনোনয়নপত্র পেয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে ৭৩১ প্রার্থী বা মোট ২৭ শতাংশ প্রার্থীকে বাতিল করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দ্বৈত নাগরিকত্বের দায়ে আওয়ামী লীগ নেতা শাম্মী আহমেদের (বরিশাল-৪ আসনে) প্রার্থিতা বাতিল করেছে ইসি।

২. নির্বাচনী প্রচারণা, আচরণবিধি এবং শাস্তি
নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ইসি আওয়ামী লীগের শতাধিক সংসদ সদস্যকে ৩০০ বারসহ মোট ৭৬২ বার শোকজ করেছে । এছাড়াও প্রার্থী বা তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ৬৩টি মামলা করেছে।

৩. নির্বাচনের দিন ইসি কর্তৃক গৃহীত কঠোর পদক্ষেপ
ইসির তথ্য অনুযায়ী, ১৪০টি কেন্দ্র থেকে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্তত ৯টি নির্বাচনী এলাকার ২১টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগে ৪২ জনকে আটক করা হয়েছে।
দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হুমকি দেওয়ার অভিযোগে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীকে (চট্টগ্রাম-১৬) অযোগ্য ঘোষণা করেছে ইসি। উদাহরণস্বরূপ, নরসিংদী-৪ আসনে ব্যালট ভর্তির অভিযোগে শিল্পমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের ছেলেকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে ইসি। একটি ভোট কেন্দ্র স্থগিত থাকায় ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের ফলাফলও স্থগিত করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

৪. ২৭% থেকে ৪১% ভোটার টার্নআউট বিতর্ক
নির্বাচন কমিশন প্রায় প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর হালনাগাদ তথ্য পায়। এর মানে হল যে ২৭% ভোটারের তথ্য (বিকাল ৩:০০ টায় বলা হয়েছে) কমপক্ষে দুই ঘন্টা পুরানো ছিল। অতএব, ৪১% এর বিকাল ৪:০০ ঘটিকায় আপডেট হওয়া তথ্যে তিন ঘন্টার ব্যবধান ছিল। এটিও উল্লেখ করা উচিত যে, নির্বাচনের সকালটি ছিল ব্যতিক্রমী শীতল, পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা প্রায় ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তাদের ভোট দেওয়ার জন্য দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল, যার আপডেটগুলি কেবল দিনের পরেই গণনা করা হয়েছিল। তাছাড়া, নির্বাচনে কোন সহিংসতা হচ্ছে কিনা তা বুঝার জন্যেও অনেকে অপেক্ষা করেছেন। নির্বাচনে কোন সহিংসতা না থাকায় শেষ সময়ে উপস্থিত হয়ে তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন বলেই ভোটার টার্নআউট বেড়েছে।

৫. আওয়ামী লীগ এর হেভিওয়েট প্রার্থীদের পরাজয়
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রায় ২ ডজন হেভিওয়েট প্রার্থী ও ১৪ দলের বড়নেতাদের পরাজয়ই প্রমাণ করে এ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও তিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঢাকা-১৯ আসনে ট্রাক প্রতীকে প্রতিনিধিত্বকারী স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল ইসলাম ৮৪,৪১২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মোঃ এনামুর রহমান (আওয়ামী লীগ প্রার্থী) ৫৬,৩৬১ ভোট পেয়েছেন।

যশোর-৫ আসনে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ও দুইবারের সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য, যিনি স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি ৭২,৩৩২ ভোট পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াকুব আলী (প্রাপ্ত ভোট: ৭৭,৪৬৮টি) এর কাছে পরাজিত হয়েছেন।

হবিগঞ্জ-৪ আসনে পরাজিত হয়েছেন অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, বেসামরিক বিমান পরিবহন প্রতিমন্ত্রী এবং দুইবারের এমপি (প্রাপ্ত ভোট: ৬৯,৫৪৩টি) স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন (প্রাপ্ত ভোট: ১৬৯০৯৯টি) এর কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন।

গাজীপুর-৫ আসনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি এবং চারবারের সংসদ সদস্য (প্রাপ্ত ভোট: ৬৭,৭৮৩টি) স্বতন্ত্র প্রার্থী আখতারুজ্জামান (প্রাপ্ত ভোট: ৮২,৭২০টি) কাছে পরাজিত হয়েছেন।
কিশোরগঞ্জ-২ আসনে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্তকারী ও পুলিশের সাবেক ডিআইজি হিসেবে খ্যাত আবদুল কাহার আকন্দ ৬৮,৯৩২ ভোটের ব্যবধানে স্বতন্ত্র প্রার্থী সোহরাব হোসেন (প্রাপ্ত ভোট: ৮৯,৫৩৯ টি) নিকট পরাজিত হয়েছেন।

মাদারীপুর-৩ আসনে অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের মুখে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপ (প্রাপ্ত ভোট: ৬১,৯৭১টি) অপেক্ষাকৃত অপরিচিত তাহমিনা বেগম (প্রাপ্ত ভোট: ৯৬,৬৩৩টি) এর নিকট পরাজিত হয়েছেন।

সুনামগঞ্জ-২ আসনে বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজি) এর ছোট ভাই চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ৫৮ হাজার ৬৭২ ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছেন। তাঁর বিপরীতে, একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ৬৭,৭৭৫ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন।
কুষ্টিয়া-২ আসনে সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও তিনবারের সংসদ সদস্য, জাতীয় নেতা ও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্র হাসানুল হক ইনু (প্রাপ্ত ভোট: ৯২,৪৪৫ টি) স্থানীয় নেতা কামারুল আরেফিন (প্রাপ্ত ভোট: ১১৫,৭৯৯টি) কাছে পরাজিত হন।

পিরোজপুর-২ পর্যবেক্ষণ করেছেন ছয়বারের সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী, প্রভাবশালী জাতীয় নেতা এবং ইত্তেফাক সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তার প্রাক্তন রাজনৈতিক সচিবের কাছে ৭০,৬৮১ ভোটে হেরেছেন। সেখানে বিজয়ী প্রার্থী ৯৯,২৬৮ ভোট পেয়েছিলেন।

নিরপেক্ষতার অফুরন্ত উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও টিআইবির এহেন বিভ্রান্তিমূলক রিপোর্টের পদ্ধতি নিয়ে কিছু প্রশ্ন করা প্রাসঙ্গিক বটে।

ক) টিআইবি রিপোর্ট পরিমাণগত ফলাফলসহ তার রিপোর্ট প্রদান করেছে। যদিও পদ্ধতি বিভাগ (বিভাগ-৩, পৃষ্ঠা-৩) বলে যে, তারা তাদের উপসংহারে আসার জন্য গুণগত এবং পরিমাণগত উভয় ডেটা ব্যবহার করেছে, কিন্তু তারা কীভাবে পরিমাণগত ফলাফলে এসেছে তার কোনও প্রক্রিয়া উল্লেখ নেই।

খ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে তারা ৩০০টির মধ্যে ৫০টি নির্বাচনী এলাকার নমুনা নিয়েছে, তারা কতগুলি ভোট কেন্দ্রের নমুনা নিয়েছে তার কোনও উল্লেখ নেই। সর্বশেষ নির্বাচনের সময় ৪২,৩৫০টি ভোট কেন্দ্র ছিল। কিভাবে তাদের পদ্ধতি কার্যকর হতে পারে যখন তারা সেই সংখ্যাটি প্রকাশ করেনি? তাদের ছিল মাত্র ৩ জন গবেষক এবং ৪ জন গবেষণা সহকারী। এত অল্প সময়ে এত ছোট টিম দিয়ে নির্বাচনের পুরো মেকানিজম জরিপ করতে পারলেন কীভাবে?

গ) কেউ যদি অনুচ্ছেদ ৫ (পৃষ্ঠা ৫,৬) পড়ে তবে এটি স্পষ্ট হবে যে এই প্রতিবেদনটি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। এতে বিএনপির ঐতিহাসিক অনিয়ম ও সাম্প্রতিক সহিংসতার কিছুই উল্লেখ করা হয়নি যেখানে আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে বলো হয়েছে য়য, ক্ষমতা অব্যাহত থাকার কৌশল বাস্তবায়নে একতরফা নির্বাচন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে, যা পক্ষপাতমূলক।

৭. সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষণা দলের অভিজ্ঞতা
প্রতিবেদনের পিছনে যে গবেষণা দল কাজ করেছেন তাদের পটভূমির দিকে তাকালে দেখা যায়, দুজনের ক্লাইমেট ফাইন্যান্স গভর্নেন্সে অভিজ্ঞতা রয়েছে, অন্যজনের ডেটা অ্যানালিস্টের যার বেশিরভাগ কর্পোরেট বিক্রয় খাতে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। হবেষক দলের কারোরই পরিসংখ্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা নির্বাচন প্রতিবেদনের সাথে যুক্ত কোনো প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রের পটভূমি নেই। এ বিষয়ে তাদের প্রকাশিত কোনো একাডেমিক পেপার পাওয়া যায়নি।

পরিশেষে, বলতে চাই, অনঅভিপ্রেত দেশি ও বৈদেশিক পরাশক্তিদের অনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে নির্বাচন কমিশন একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে একটি স্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। করোনা মহামারি ও বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনাটা অত্যন্ত জরুরি। অতীতের ঘটে যাওয়া গঠনার চর্বিত চর্বন করে সময় নষ্ট না করে দেশে অর্থনীতি করাই সাধারণ মানষের প্রত্যাশা। তাই, ”দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন” এর মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে সে সরকারকে ইতোমধ্যে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েল্থ, ওআইসি, যুক্তরাষ্ট্র, চিন, ভারতসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ অভিনন্দন জানিয়ে একসাথে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাই, বর্তমান সরকার তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সকল মহলের সহযোগিতা প্রয়োজন।

লেখক: প্রফেসর, মৎস্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।






উত্তর দিন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.