প্রধান সূচি

জামায়াতের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক অপকৌশল

ধর্মীয় দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে “ভারত” এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে “পাকিস্তান” নামক দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব নেয় মুসলিম লীগ। কিন্তু পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের এক নব্য ঔপনিবেশে পরিণত হয়।

সেসময় পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মীয় জাতিসত্তাকে বিবেচনায় রেখে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন “আওয়ামী মুসলিম লীগ” গঠিত হয়। ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন এবং নির্বাচনে জয়লাভ করেন।

শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অনুধাবন করেন যে, দলটিকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দিতে হবে। তাই, ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দিয়ে “আওয়ামী লীগ” প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯৬৬ সালের ১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের সকল বৈষম্য ও নিপীড়নকে উপেক্ষা করে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর “বাংলাদেশ” রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।

বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকে বাধা দিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে “জামায়াতে ইসলামী” পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনী গঠন করে বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তি যুদ্ধে সমর্থন করেছিল তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করে কিংবা হত্যা করতে সহযোগিতা করে।

যেহেতু জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান জামায়াতের একটি শাখা ছিল, তাই তারা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকে বাধাগ্রস্ত করে ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে সমুন্নত রাখতে বদ্ধ পরিকর ছিল। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলে ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয় (অনুচ্ছেদ নং-৩৮)।

সেসময় আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক পাঁচটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের এবং নিকট আত্মীয়দের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে, জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে সংবিধানের ৩৮ নং অনুচ্ছেদে সংশোধনী (দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র-পঞ্চদশ সংশোধন) আনে, যা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা পায়। ফলে এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করার অধিকার লাভ করে।

তাছাড়া, জিয়াউর রহমান কর্তৃক দালাল আইন বাতিল হওয়ায় ১১ হাজার রাজাকার জেল থেকে ছাড়া পায় এবং গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৭৯ সালে “জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ” এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। বর্তমানে জামায়েতে ইসলামী ছাড়াও আরও কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে যারা কট্টর ডানপন্থী।
স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে নির্বাচনে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী জনগণ আশা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। কিন্তু নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী তথা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর অপপ্রচারে তা আর হয়ে উঠেনি।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশ ভারত হয়ে যাবে, মসজিদে উলুধ্বনি দিবে, বাঙালি হিন্দু যারা ভারতে চলে গিয়েছে তাঁরা আবার ফিরে এসে তাঁদের ফেলে যাওয়া জমি-বাড়ি-ঘর ফেরত নিবে, সঠিকভাবে ইসলাম ধর্ম পালন করতে দিবে না, ইত্যাদি অপপ্রচার চালিয়ে সরলমনা সাধারণ মানুষদের নৌকা মার্কায় ভোট দেয়া থেকে বিরত রেখেছিল।

ফলে জামায়াতে ইসলামী এর সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে বিএনপি যারা স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেন।

স্বাধীনতা বিরোধীরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে ইসলামী ভাবধারা তথা শরিয়াভিত্তিতে পরিচালিত অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, এনজিও, ব্যাংক, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স তাদের নেতা-কর্মীদের প্রদান করেছিলেন যারা এখন মাঠপর্যায়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ধর্মান্ধতা তৈরি করছে।

১৯৯১-১৯৯৫ এবং ২০০১-২০০৭ সালে দু’মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন- বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির কর্তৃক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ঘটনাবলির কথা মনে করে এখনও অনেকে ভয়ে আঁতকে উঠে।

২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেন। নির্বাচনের ইশতেহার অনুযায়ী গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ এর ৬ ধারা বলে ১৯৭১ সালে সংগঠিত অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের বিচারের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হলে তাদের পক্ষে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়। ফলে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় জামায়াতে ইসলামী এখনও পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৩৮ নং অনুচ্ছেদে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন বিষয়ে পুনঃশর্তারোপ করে। শর্তানুযায়ী ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হলে সে ক্ষেত্রে দল গঠনের অধিকার থাকবে না।

এ শর্ত পূরণ না হওয়ায় বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন প্রদান থেকে বিরত থেকেছেন। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়েতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচন বাঞ্চাল করার জন্য পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ ও অগ্নি সন্ত্রাস সংঘটিত করে।
২০২৪ সালের প্রারম্ভে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে প্রতিহত করার জন্যও ২০১৪ সালের অনুকরণে বিএনপি-জামায়াত জোট ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে গাড়ি ভাঙচুর, রেল লাইনের স্লিপার খুলে নেয়া, বোমা নিক্ষেপ ও অগ্নি-সন্ত্রাস সংঘটিত করছে।

তাই, সরকারের উচিৎ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়ীদের মাধ্যমে সরকার গঠন করা এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রেখে রূপকল্প-২০৪১ (স্মার্ট বাংলাদেশ) বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়া।

লেখক: মৎস্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।






উত্তর দিন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.