প্রধান সূচি

অসময়ের অসহযোগ, দুর্ভোগ দুর্ভোগ

২৮ অক্টোবরের সরকার পতনের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর লন্ডনে বিএনপির পলাতক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। এই আন্দোলনের ডাক, এ বছরের রাজনীতিতে সেরা কৌতুক হিসেবে মনে করা যেতেই পারে। কারণ এর মাধ্যমে পরিষ্কার হয়েছে, রাজনীতি চর্চা এবং এর ইতিহাস সম্পর্কে তার ন্যূনতম ধারণা নেই। যদি থাকত, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই জানতেন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক কখন, কীভাবে দিতে হয়? অসময়ের কোন ডাকাডাকিতে হাসাহাসি ছাড়া আর কিছুই হয় না।

এরকম ম্রিয়মাণ অবস্থায় যখন বিএনপি ছিন্নভিন্ন প্রায়, তখন অসহযোগ আন্দোলন আদৌ একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা কি না—তা বোঝার মতো অবস্থায় যে তিনি নেই সেটাও এখন প্রতীয়মান। বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী নির্বাচন প্রতিহত করার নামে সারাদেশে জ্বালাও-পোড়াও কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তর জানাচ্ছে, ২৮ অক্টোবর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ২৪১টি যানবাহন ভাঙচুর করা হয়েছে। একই সময়ে ৩৭৬টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে আরও জানা যায়, শুধু রাজধানীতে ১২৩টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তিনটি ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যে গোষ্ঠী বর্তমানে জ্বালাও-পোড়াও চালাচ্ছে তারা অতীতেও এধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে অসহযোগ আন্দোলন নতুন নয়। বিংশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, যখন সংসদের পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকা বারবার পিছিয়ে দিচ্ছিল, তখন জাতির পিতা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। সেই সময় সারাদেশ ছিল উত্তাল। জনগণের একমাত্র নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পুরো দেশ আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ওই সময় বঙ্গবন্ধু যা নির্দেশ দিতেন তা পালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়েছিল সেই সময়ে। সেই বাস্তবতার সঙ্গে এখনকার বাস্তবতা তুলনা কোনো বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন মানুষ করতে পারেন না।

স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলন হয়েছে। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদের পেটোয়া বাহিনীর হামলায় নিহত হন ডা. মিলন। মিলনের মৃত্যুর পর সারাদেশে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে, ডাক দেওয়া হয় অসহযোগ আন্দোলনের। সেই সময় সব সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি কর্মকর্তারা তাদের অফিস থেকে বেরিয়ে আসেন। দেশে এক উত্তাল পরিস্থিতি তৈরি হয়। জনগণ স্বৈরাচারের পতনের দাবিতে অনড় অবস্থানে চলে যায়। সেই রকম বাস্তবতাও এখন নেই।

বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলন আরেকটি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। বেগম খালেদা জিয়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অস্বীকার করে যখন একতরফাভাবে নির্বাচন করার উদ্যোগ নেন, তখন সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল এক উত্তাল গণআন্দোলন। সেই গণআন্দোলনের মুখে ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন পণ্ড হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও বেগম খালেদা জিয়া নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। জনগণ সেই সরকার প্রত্যাখ্যান করেন এবং খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। এই সময়ে গড়ে ওঠে ‘জনতার মঞ্চ’। খালেদা জিয়ার পতন না হওয়া পর্যন্ত মানুষ রাজপথে অবস্থান নেন। সেই অসহযোগ আন্দোলনের ফলেই শেষ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এই তিনটি বড় ধরনের অসহযোগ আন্দোলন আমরা দেখেছি। এই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেকোন গণদাবিতে আন্দোলন যখন উত্তাল থাকে, মানুষ থাকে ঐক্যবদ্ধ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঠিকঠাক থাকে এবং রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা থাকে, জনগণের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকে এবং তাদের একজন বিকল্প নেতার প্রতি আস্থা তৈরি হয়, তখনই অসহযোগ আন্দোলন করা সম্ভব হয়। কিন্তু এখনকার বাস্তবতা কী তাই? নিশ্চয়ই নয়?

আজকের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিএনপি এখন নিজেরাই ধুকছে। বিএনপির নেতাদের বেশিরভাগই জেলে। আর যারা জেলের বাইরে আছেন, তারা পলাতক। সরকারের সাথে প্রকাশ্যে এবং গোপনে নানারকম আঁতাত করে তারা বাইরে রয়েছেন। দেশের বেশিরভাগ মানুষ আন্দোলনকারীদের জ্বালাও পোড়াও সমর্থন করছেন। নাশকতাকারীদের ধরে পুলিশে সোপর্দ করছেন। ২০০৮ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের কল্যাণ ও দেশের উন্নয়নের জন্য শত শত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। এর ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই অবস্থায় সেই সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন ডাকাটা ধৃষ্টতা ছাড়া আর কী হতে পারে?

মানুষ আসলে স্বাভাবিক কর্মজীবন যাপন করতে চায়। দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, অসহযোগ আন্দোলন তো দূরের কথা, স্বাভাবিক আন্দোলন করার মত পরিস্থিতিও দেশে নেই। আর এরকম বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা না করে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা এক ধরনের বিবেক বিবর্জিত নেতৃত্বেরই প্রতিফলন। তারেক জিয়া যে রাজনীতিতে এখনো অপরিপক্ব, অপরিণামদর্শী এবং অবিবেচক, এই কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি তা আরেকবার প্রমাণ করলেন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।






উত্তর দিন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.