ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে কিছু কথা

সময়টা ফেব্রুয়ারীর ১১ তারিখ ২০২০। বানিজ্যিক কাজে বন্ধু শোয়েবের সাথে ঢাকায় যাই। সকাল ৫ টা ৩০ মিনিটে সদরঘাটের রাস্তায় দু-জনে হাঁটছি, উদ্দেশ্য একটা ভালো রেস্টুরেন্টে সকালের খাবারটা সেরে নেয়া। যাই হোক খাবার সেরে আমরা সদরঘাট থেকে নৌকা করে কালীগঞ্জে গেলাম। সারাদিন সেখানেই কাটাই।
বন্ধু শোয়েবের তৈরী পোশাকের দোকান আছে পিরোজপুরে। ওর দোকানের জন্য কেনাকাটা করে এবার উদ্দেশ্য ঢাকার ওয়ারী। রাত্রি যাপন ‘হোটেল ওসমানী ইন্টারন্যাশনাল’ খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও মনোরম পরিবেশ, একটা ফ্রেশ গোসল দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে একটা শান্তির ঘুম দিবো।
সদর ঘাট থেকে রিক্সা করে যেত আমাদের ১২০ টাকা লাগতো হোটেলের সামনে পৌঁছে দিবে।
কিন্তু মনে মনে পুষে রাখা ইচ্ছে ঘোড়ার গাড়িতে চড়া, সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত পা যেন চলছিলো না, বার বার মনে হচ্ছিলো রাস্তার পাশেই কোথাও শুয়ে পড়ি।তবুও আজ ঘোড়ার গাড়িতে চলতেই হবে। অতি উৎসাহ নিয়ে বন্ধুকে বললাম চল ঘোড়ার গাড়িতে গুলিস্তান যাবো, ওখান থেকে রিক্সা করে আবার ওয়ারীতে আসবো। ও রাজি হয়ে গেলো।
একটু হেঁটেই উঠে পড়ি কাঙ্খিত সেই ঘোড়ার গাড়িতে। অতি আনন্দে সামনে গিয়ে বসি, মানে দুটি ঘোড়ার ঠিক পিছনেই যে সিটটি থাকে। মনে হচ্ছিল যেন- নিজেই ঘোড়া নিয়ে ছুটে বেড়াই পুরো শহর।
একটা গাড়িতে ৮/১০ জন যাত্রী নিয়ে তারা গন্তব্যে ছোটে। কিছুক্ষণ পরেই পরিপূর্ণ যাত্রী হলে ঘোড়া দু’টি ছুটলো ঠং ঠং ঠং শব্দ করে। ভালোই লাগতে শুরু করলো। হঠাৎ ই শ্যাং করে একটা শব্দে আমার ঘোড়ার গাড়িতে চরার নেশা কাটলো!
বুঝতে পারলাম যিনি ঘোড়া দু’টিকে পরিচালনা করছেন তিনি একটা লাঠির মাথায় এক গজের মত একটা শক্ত প্লাস্টিকের রশি দিয়ে একটি ঘোড়ার পিঠে আঘাত করেছেন, বাতাস কেঁটে শ্যাং করে শব্দ করে ৩ ফুটের একটা দাগ বসে গেলো ঘোড়ার পিঠে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম অমন অজস্র আঘাতের দাগ! নাহ্ আর ভালো লাগলো না বিষয়টা। খুবই হৃদয় বিদারক লাগলো, খুব অমানবিক। নিষ্ঠুর লাগলো নিজের প্রতি, নিজেরই একটা কেমন খারাপ লাগা ঘৃণা সৃিষ্ট হলো।
সারাদিনের যান্ত্রিকতা শব্দ দূষণ আর ক্লান্তিতে চোখ ঝাপসা হয়ে মাথা আর কানের মধ্যে গুম গুম করছিলো বেশি কিছু ভাবতে পারছিলাম না, শুধু অপেক্ষা কখন নামবো গাড়ি থেকে।
হোটেলে গিয়ে পৌঁছালাম। ফ্রেশ হয়ে একটু শুয়ে আর মন চাচ্ছে না রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে আসি। যদিও ওখানে খাবার ব্যবস্থা ছিলো, কিন্তু আমি আবার খাবার বেলায় ভিষণ লোভী। গাড়ি মিস করতে রাজি কিন্তু খাবার না।
নিচেই রেস্টুরেন্ট ‘হোটেল প্রিন্স’ এ খাবার শেষ করে করলাম। চোখে একটা শান্তির ঘুম ঘুম ভাব, কিন্তু মনে কোথায় একটা খারাপ লাগা- আমার মনুষ্যত্ব বিবেককে নাড়া ছিলো। কখন ঘুমিয়ে পরেছি নিজেও যানি না।
পরেরদিন সারাদিন বঙ্গবাজার আর সিটি প্লাজায় কেনাকাটা, কিন্তু মনে যেন শান্তি পাচ্ছি না। এখন আমার উদ্দেশ্য একটাই গবেষণা- ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে। পরের দিন চলে গেলাম সদরঘাট। অনেকগুলো ঘোড়ার গাড়ি। একটা গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, ভাবতে লাগলাম এত বড় একটা লোহার গাড়ি এত ভারী তার উপরে ৮/১০ জন মানুষ। মাত্র দু’টি ঘোড়া দ্বারা বহন করানো হচ্ছে। এমনকি ট্রাকবোঝাই সমতুল্য আসবাবপত্রও নির্বিচারে তাদের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, যা ঘোড়ার ন্যায় অবলা প্রাণীর পক্ষে শুধু কষ্টকরই না মারাত্মক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু প্রতিনিয়ত এভাবেই বেতের আঘাতের ভয়ে মণকে মণ ওজন আসবাবপত্র নিয়ে ছুটে চলে এক স্থান থেকে অন্য স্থান। পিটিয়ে পিটিয়ে চালিত করা হয় অবলা এই প্রাণীদের। অবলা বলে মুখে কিছু বলতেও পারে না। পায়ের নিচে খুড়াতে লোহা দিয়ে টিনের পাত পিটিয়ে দেয়া হয় যাতে পায়ের তলা রাস্তার ঘষায় ঘষায় খেয়ে না যায়! কিন্তু কিছুদিন পর পর সেটা খসে পড়ে তাই বার বার খুড়োতে লোহা পিটিয়ে পিটিয়ে পুরো খুড়া ঝাঁজরা ঝাঁজরা করে ফেলেছে প্রতিটা ঘোড়ার ‘পা’ কে।
মুখে একটা লোহার বেরী পরানো থাকে, ইচ্ছে করলেই মুখ বুঝতে পারে না। ভাবুন তো যদি আপনার আমার মুখে একটা লোহার বেরী দিয়ে মাথার পিছন দিয়ে আটকে রাখা হয় সারাদিন কেমন লাগবে!
সারাদিন ঘোড়াগুলোর মুখ থেকে সাদা সাদা ফ্যানার মত পরতে থাকে, আহ কি অসহ্য যন্ত্রণা। বিশ্রামেরও কোন সুযোগ নেই ঘোড়াগুলোর। উপরন্তু ঘোড়াকে আঘাত করে করে মাইলকে মাইল পথ বোঝা টেনে নিতে বাধ্য করা হয়। এরূপ মারাত্মক অন্যায়ের প্রতিবাদ করারও কোন ক্ষমতা নেই অবলা এই প্রাণীগুলোর। অসহ্য এই পাহাড়সম বোঝা বইতে বইতে কখনো কখনো দেখা যায় পা আর চলছে না, মাটিতে শুয়ে পড়ার অবস্থা। জিহ্বা বেরিয়ে পরেছে, অঝরে অশ্রু ঝড়ছে দু’চোখ বেয়ে।
কিন্তু এ সমাজ, এ সমাজের পাষন্ড হৃদয়হীন নিষ্ঠুর কঠোর মনের মনুষ্যত্বহীন জাতির চোখে পরে না নিরীহ এই প্রাণীর কান্না ভেজা চোখ। হৃদয় গলে না পাষন্ড মনুষ্যত্বের, বেত্রাঘাত করে করে ইচ্ছের বিরুদ্ধে চালিত করা হয় মাইলের পর মাইল।
যারা ঘোড়ার গাড়িকে জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়ে এই অবলা প্রাণীকে দিয়ে বছরের পর বছর বেগার খাটাচ্ছে, টাকার কাছে মায়া ভালোবাসা আর মানবিকতার কোন মূল্যই নেই এই পেশার স্বার্থপর মানুষদের কাছে।
আমাদের দেশে তিনটি বড় উৎসব পালিত হয়, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, ও দুর্গা পূজা। এমন মহা উৎসবকে কেন্দ্র করে ঘোড়ার গাড়িকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে বিলাসিতা ও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে। তখন মাত্রাতিরিক্ত ওভারলোড নিয়ে ছেলে মেয়েদের একটা বড় দল মিলে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় পুরো শহর। তখন ধারণ ক্ষমতার চেয়েও দু’চার জন বেশি নিয়ে চলতে হয় অসহায় প্রাণী দু’টোর। অনাকাঙ্খিত এই দুঃসহ ভার চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে সামান্য দুটি নিরীহ প্রাণীর কাঁধে। এমন অমানবিকতা সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে আমাদের মানায় না। জীবিকা নির্বাহের আরো হাজার পথ খোলা আছে তবুও এই অবলাদের মুক্তি দাও তোমরা। “বাঁচতে দাও, একটি সুন্দর জীবন দাও।
গুরু জনেরা বলে গেছেন, “জীবে প্রেম করে যে জন সে’জনই সে’বিছে ঈশ্বর” (স্বামী বিবেকানন্দ)
ইতিহাস থেকে জানান যায়, ১৮৩০ সালে সর্বপ্রথম আর্মেনীয়দের হাতে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয়। আর্মেনিয়ার অধিবাসীদের আর্মেনিয় বলা হয়ে থাকে। ধারণা করা হয়, ১৮৩০ সালের সময় আর্মেনিয়রা পুরান ঢাকায় বসবাস করতেন। এই পুরান ঢাকাতে তাদের জমিদার বংশ ছিল। তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশে এ দেশের পুরান ঢাকায় তাদের বসতি গড়ে তোলেন। ব্যবসার তাগিদে তারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে দোকান দিয়েছিলেন। এই দোকানগুলোর মধ্যে সেই সময়ে ঢাকার শাঁখারীবাজারে অবস্থিত ‘দি সিরকো এন্ড সন্স’ এর বেশ সুনাম ও নামদাম ছিল। আর এই সিরকোতেই বাণিজ্যিকভাবে ১৮৫৬ সালে প্রথম ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয় বলে যানা যায় !
তখনকার ঘোড়ার গাড়ি ‘দঠিকা গাড়ি’ নামে পরিচিত ছিলো। ব্যবসা-বাণিজ্যের নিমিত্তে তখন ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করা হতো। এমনকি যাতায়াতে দেশের প্রধান বাহন হয়ে উঠেছিলো সেই সময় ঘোড়ার গাড়িই। এছাড়াও পালকি হিসেবেও একসময় ঘোড়ার গাড়ির বেশ প্রচলন লক্ষ্য করা গেছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে ঘোড়ার পালকিতে করে বর-কনে বহনের বিষয়টিও একসময় গ্রামাঞ্চলে বেশ দেখতে পাওয়া গেছে।
যাই হোক, ঘোড়ার গাড়ি এদেশে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে থাকলেও মাত্রাতিরিক্তভাবে ঘোড়াকে কাজে লাগানো হচ্ছে মণ কয়েক ভারি আসবাব-মাল বহনের কান্ডারি হিসেবে, যা কখনোই কাম্য নয়।
তাই এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম মহোদয়ের দৃষ্টি কামনা করছি। ঘোড়ার গাড়ি যেন এদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়েই থাকে। বিষয়টিতে বিশেষভাবে নজর দিবেন। অবিলম্বে ঢাকার ওই পিচঢালা কঠিন রাজপথে চলাচলকারী ঘোড়ার গাড়ি বন্ধ করুন। অবলা এই প্রাণীর আর্তনাত, হৃদয় কাঁপানো চাপা কান্না ও ব্যথা থেকে মুক্তি দিন। জোর দাবি জানাচ্ছি- অচিরেই ঘোড়ার গাড়ি বন্ধ করা হোক।