প্রধান সূচি

বরিশালে জলাবদ্ধতায় বোরো ব্যাপক ধানের ক্ষতি

বিধান সরকার, বরিশাল :
বৈশাখের ২ তারিখ থেকে টানা বৃষ্টি, একনাগাড়ে সাত দিন বৃষ্টি ঝরেছে। সেই বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে বরিশালের নীচু জমিতে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বোরো ধানের, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকরা। বিশেষ করে জেলার আগৈলঝাড়া, উজিরপুর ও গৌরনদী উপজেলারে কোনো কোনো স্থানে বেরো ধানের ক্ষতি হয়েছে ২০ ভাগের অধিক। মাঠে জল জমায় ধান কাটতে যেমন বদলা খরচ বেড়েছে, অপরদিকে পানিতে ডোবা ধানের মূল্য মণ প্রতি দুই থেকে আড়াই শ’ টাকা কম দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। বোরোর পরে সামনে আমন ধানের বীজ বপন নিয়ে চিন্তিত কৃষকরা। তাদের অভিযোগ, এমন সমস্যার দিনে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের দেখা মেলে না, করণীয় বিষয় জানতে। তবে কৃষি বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মোঃ মাহমুদুল ফারুক দাবি করেছেন, এই বৃষ্টিতে ধানের কোনো ক্ষতিই হবে না। রবি শস্যের একটু যা হতে পারে।
জেলার ১০টি উপজেলায় এবারে ৫৪ হাজার ৩১০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে নীচু এলাকা আগৈলঝাড়া উপজেলায় সিংহভাগ চাষী এই বোরো ধানের ওপর নির্ভর করেন। আমন বা আউশের আবাদ এখানে কদাচিৎ হয় মাত্র। এই উপজেলার গৌহার, সেরল আর গৌরনদী উপজেলার দত্তেরাবাদ গ্রামে সরেজমিনে দেখা যায় কৃষকরা হাঁটু পানিতে ঝড়ে হেলে পড়া বেরো ধান কাটছেন। কোনো কোনো কৃষাণী রাস্তার পাশে উচুঁ জমিতে ধান উড়ানোর কাজ করছেন। কথা হয় সৈয়দ মল্লিক, জাকির মল্লিক, মনির মল্লিকসহ কয়েকজন কৃষকের সাথে। সৈয়দ মল্লিক সাড়ে ৪ জৈষ্ঠ্য (৯০ শতক) জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। জৈষ্ঠ্য প্রতি তার সার, ওষুধ, সেচ ও বদলা বাবাদ ৬-৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তিনি আশাবাদী ছিলেন, ৬০ থেকে ৭০ মণ ধান মিলবে জমি থেকে। কিন্তু থেমে থেমে চার দিন, এরপর টানা তিন দিন ঝড় ও বৃষ্টি হয়েছে। জমিতে পানি দাঁড়িয়েছে। এখন ৩০ মণের বেশি ধান পাওয়া দুষ্কর হবে।
কৃষাণী ভানু বেগম জানিয়েছেন, ৮ জৈষ্ঠ্য জমিতে তাদের ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। এখন পানিতে ডুবে যাওয়া ধানে চিটার ভাগ বেশি হচ্ছে আর রং নষ্ট হয়ে যাওয়াতে এই ধানের দাম বাজারে মণপ্রতি আড়াই শ’ টাকা কমে সাড়ে ৪ শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আরেক কৃষাণী পারুল বেগম সাড়ে ৩ জৈষ্ঠ্য জমি বর্গা নিয়ে বেরোর আবাদ করেছিলেন। নীচু জমিতে জমানো পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই, অপরদিকে সামনে বর্ষা মৌসূম, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এই অবস্থায় আমন ধানের বীজতলা করবেন তারও কোনো উপায় নেই।
গৌহার গ্রামের অমল হালদার জানিয়েছেন, পানিতে ক্ষেত তলিয়ে থাকায় ধান কাটতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। ৩শ’ টাকার বদলা এখন ৫শ’ টাকায় উঠেছে। পানিতে শরীরের সমস্যা হওয়াতে জেলার বাইরে থেকে আসা মজুরদের অনেকেই না বলে চলে গেছেন। তাই বদলা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে দত্তেরাবাদ গ্রামের বাদশা হাওলাদার, তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে জমির ধান কাটছেন। বৃষ্টির সাথে ঝড়ো বাতাসে তার এক একর জমির ধান নুয়ে পড়েছে।
এই কৃষক আরো জানিয়েছেন, ধান এখনো পুরো পাকেনি তারপরও পানি লাগায় পুরোটা নষ্ট হবে এই ভয়ে কেটে আনছেন। ধান কিছুটা রক্ষা করতে পারলেও খড়কুটা, যা গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তার পুরোটাই পানিতে থাকায় পচে যাচ্ছে।
একই কারণে ইতিমধ্যেই পাশের বাড়ির দুটো গাভি বিক্রি করে দিয়েছেন বলে জানালেন শাহীন সিকদার নামে উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যায়নরত এক ছাত্র। নীচু জমি হওয়ায় তাদের এলাকার সব কৃষক বোরো ধানের আবাদ করেন। এখান থেকে পাওয়া খড় গাঁদা করে রাখেন সারা বছর গবাদি পশুর খাবার হিসেবে। এবারে আর সেই সুযোগ থাকছে না। তাই আগেভাগে গাভিদুটো বিক্রি করে দিয়েছেন।
এদিকে, দুর্যোগকালীন সময়ে মাঠ পর্যায়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের দেখা মেলছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন উল্লেখিত গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মোঃ মাহমুদুল ফারুক জানিয়েছেন, যে বৃষ্টি হয়েছে এতে বেরো ধানের কোনো ক্ষতিই হবে না। বরং তাদের হিসেবে বাম্পার ফলন হবে। তার মতে, ৮০ ভাগ ম্যাচিরিউড হওয়ায় ধানে পানি লাগায় কালারের পরিবর্তন হতে পারে, তবে ভেতরে থাকা চালের কোনো সমস্যা হবে না।
কৃষকদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেছেন, কোনো কোনো উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের ব্লকে সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার কৃষক থাকেন। এজন্য সবার সাথে দেখা করা সম্ভব হয় না বটে, তবে তাদের পাক্ষিক পরিকল্পনায় ভিজিটের স্থানের বর্ণনা থাকে। এ ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে তাদের নির্ধারিত স্থানে বসেন। সেখান থেকে কৃষকরা সহজে পরামর্শ নিতে পারেন। আর দুর্যোগের কারণে ১৫ মে পর্যন্ত কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের ছুটি নেয়া যাবে না বলে এই বিভাগের মন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে। এ ছাড়াও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের মাঠে থেকে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের তদারকি করার নির্দেশ দিয়েছেন।

Please follow and like us:





উত্তর দিন

Wordpress Social Share Plugin powered by Ultimatelysocial