প্রধান সূচি

পূর্ব বাংলা লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন

॥ নূর হোসাইন মোল্লা ॥

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাতে জেনারেল আইয়ুব খান এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিনা রক্তপাতে ক্ষমতা দখল করেন। সারা দেশে সামরিক আইন জারী করে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও বামপন্থী নেতা কর্মীদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। বন্দিদের মধ্যে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মজিবুর রহমান, আবুল মনসুর আহমেদ, সরদার ফজলুল করিম, কোরবান আলী, নুরুদ্দীন আহমেদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী প্রমুখ ছিলেন। সামরিক আইন জারী হওয়ায় পূর্ব বাংলায় নেমে আসে ভয়াবহ দমননীতি। এ অবস্থায় জামালপুর মহাকুমা (বর্তমানে জেলা) আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আলী আসাদ যবুকদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার জন্যে জামালপুরে “পূর্ব বাংলা লিবারেশন ফ্রন্ট”  নামে এক বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেন। তাঁর সাংগঠনিক তৎপরতায় সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে এক দল যুবককে সাথে নিয়ে তিনি ভারতের পশ্চিম বাংলায় যান উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহনের জন্যে। তাঁরা যখন কাজ শুরু করেন তখন হঠাৎ করে পশ্চিম বাংলা সরকার গুপ্তচর আখ্যা দিয়ে তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকার তাঁদেরকে ফেরত চেয়ে তাঁদের ওপর গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ও হুলিয়া জারীর কাগজপত্র পশ্চিম বাংলা সরকারের নিকট প্রেরণ করেন। পশ্চিম বাংলা সরকার তা যাচাই-বাছাই করে তাঁদেরকে মুক্তি দেন। তাঁরা মুক্তি পেয়ে কলকাতায় বসে বিভিন্ন দেশের কুটনৈতিক মিশনকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইউব খানের নির্যাতন অবহিত করেন এবং তাদের সহানুভূতি কামনা করেন। অতঃপর তাঁরা গাড়ো পাহাড়ের সীমান্ত দিয়ে শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী উপজেলার পাখি মারা গ্রামের পূর্ব বাংলা লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্য আশরাফ হোসেন এর বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে অতি গোপনে সাংগঠনিক তৎপরতা চালায়। গোয়েন্দা বাহিনী বিষয়টি আচঁ করতে পেরে তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পুলিশের টের পেয়ে তাঁরা মুহুর্তের মধ্যে চলে যেতে সক্ষম হন। পুলিশ বাড়ীওয়ালা আশরাফ হোসেন এবং আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু কোন তথ্য না পাওয়ায় তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়।

আলী আসাদ তখন ক্ষেত মজুরের বেশ ধরে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে আইউব খান সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার পত্র বিলি করেন। দাড়িগোফঁ এমনভাবে রাখলেন কেউ তাঁকে আলী আসাদ বলে চিনতে পারেনি। জেনারেল আইউব খান ১৯৬২ সালের ১৫ জুলাই রাজনৈতিক দলবিধি জারী করে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং রাজবন্দিদেরকে মুক্তি দিলে শেখ মুজিবুর রহমান (তখনও বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হননি) দলীয় কাজে ময়মনসিংহ যান। সেখানে দলীয় লোকদের কাছে তিনি আলী আসাদের বিপ্লবী কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে পারেন। শেখ মুজিব দলীয় লোকদের মাধ্যমে তাঁকে জানান যে, এখন থেকে আলী আসাদ প্রকাশ্যে বের হয়ে দলীয় কাজ করতে পারবেন। শেখ মুজিবের বাণী তাঁকে জানানো হলে তিনি বলেন যে, রক্ত স্বাক্ষরে শপথ নিয়েছি যে, দেশকে স্বাধীন করব। দেশের সাথে বেঈমানী করতে পারব না। দেশের স্বাধীনতার জন্যে ভারতের সহযোগিতা চাইব। ভারতের সহযোগিতা না পেলে চীন অথবা রাশিয়ার সহযোগিতা চাইব। স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতা আর সহানুভূতি পাওয়ার জন্যে তিনি সারা ভারত ঘুরে বেড়ালেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের শাসন আর শোষণ থেকে দেশ মুক্ত হলো, কিন্তু আলী আসাদের সন্ধান আজও পাওয়া গেল না।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।

Please follow and like us:





উত্তর দিন

Wordpress Social Share Plugin powered by Ultimatelysocial